পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপনা নির্মাণের গল্প

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( ডেস্ক রিপোর্টার ) : স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তব। অবশেষে স্বপ্ন হলো সত্যি, জুড়ে গেলো পদ্মার এপার–ওপার, দৃশ্যমান হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বিজয়ের মাসে সংযুক্ত হলো প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড়। গত ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ পেলো পুরো পদ্মা সেতু। দুপুর ১২টা ২ মিনিটে সেতুর সর্বশেষ এই স্প্যানটি বসে। ২–এফ আইডির এই স্প্যান বসানোর পরই যুক্ত হলো মুন্সীগঞ্জ ও শরিয়তপুর জেলা। পদ্মা সেতুর পিয়ার–১২ ও পিয়ার–১৩ নম্বরে শেষ স্প্যানটি বসানো হয়। এর মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হলো ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরো সেতু।

অনেকেই হয়তো পদ্মা সেতু কে দেখে এর পেছনের চ্যালেঞ্জ গুলো কে উপলব্ধি করতে পারেনি। হয়তো মনে হতে পারে এ আর এমন কি ! বহু দেশে হরহামেশা হচ্ছে। কিন্তু না এটা হচ্ছে পদ্মা, পদ্মা নদীকে দেখে যেমন এর বিশালতা বোঝা যায় না, ঠিক তেমনি পদ্মা ব্রিজ কে দেখেও এর পেছনের চ্যালেঞ্জ গুলো কে উপলব্ধি করা যায়না। এজন্যে আপনাকে জানতে হবে এর পেছনের গল্প।

শুধুমাত্র পাইলিং বা পাইল সম্পর্কে জানলেই আপনি হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাবেন। পদ্মা ব্রিজ এর শুধুমাত্র ৬.১৫ কিলোমিটার স্প্যান কে দেখা গেলেও, এই স্প্যান যার উপর দাড়িয়ে আছে সেই পাইল করেছে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। আসুন দেখা যাক পদ্মা সেতুর পাইলিং এর বিশালতা , নির্মানশৈলি, এবং চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে।

পদ্মা নদী 

পদ্মা সেতু সম্পর্কে জানার আগে পদ্মা নদী নিয়ে জানা যাক। পদ্মা নদীর পানির প্রায় চল্লিশ মিটার নিচে নদীর তলদেশ। চল্লিশ মিটার মানে ১৩১ ফিট প্রায়। দশ ফিট করে সাধারণত এক তালার হাইট। সেই হিসাবে, পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে পানির পৃষ্ঠের হাইট হল ১৩ তলা বিল্ডিং এর সমান। তাহলে ব্রিজের পিয়ার গুলো (সাধারণ ভাবে বললে কলাম যেগুলোকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় পিয়ার বলে ) ১৩ তলা বিল্ডিং এর সমান হতে হবে। কিন্তু কলাম যদি মাটিতে ধরে রাখা না যায়, পদ্মার যে স্রোত, কলাম তো ভেসে চলে যাবে। আর এই স্রোতের বিপরীতে পিয়ার গুলো কে টিকিয়ে রাখার জন্যে অর্থাৎ পিয়ার ধরে রাখার জন্যে নির্মাণ করতে হয়েছে পাইলিং । এই স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকাটাই যেন বিশাল এক ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ।

এছাড়া পদ্মার তলদেশের মাটি হল বালি টাইপের, নরম কাদা টাইপ। পাথরের মত শক্ত না। বেডরক প্রায় ৮ কি.মি নিচে বলে ধারনা করা হয়। ৮ কি.মি হল মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ! তো বেডরক পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন না দেখাই ভাল। অনেক দেশেই বেডরক অনেক অল্প নিচেই পাওয়া যায়। তাদের দেশে যে কোন স্ট্রাকচার বানানো অনেক কম খরচের ব্যাপার কারণ তাদের ফাউন্ডেশন বানানো অনেক সহজ, খরচও কম। আমাদের এদিক দিয়ে কপাল খারাপ। তাহলে পদ্মা নদীর ব্রিজের পাইল কতটুকু দিতে হবে?

পদ্মা সেতুর পাইলিং এর বিশালতা

বর্ষাকালে যখন অতিরিক্ত স্রোত থাকে, এই পদ্মার তলদেশের বালির মতন মাটি, ধুয়ে চলে যায়। এটাকে স্কোর হওয়া বলে। পদ্মা নদীর স্কোর হওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড হল ৬০-৬৫ মিটার। মানে নদীর নিচ থেকে ৬৫ মিটার মাটি ধুয়ে চলে গেছে। মানে ২১৩ ফিট। অর্থাৎ ২১ তলা বিল্ডিং এর সমান হাইটের মাটি ধুয়ে চলে গেছে।

পদ্মার এই প্রায় ২১ তলার সমান মাটি ধুয়ে চলে যাবার রেকর্ড বা এত বেশি পরিমাণ সেডিমেন্ট (মাটির কণা) ট্রান্সপোর্ট করার রেকর্ড অন্য কোন নদীর নেই। এ অবস্থায় পানির নিচে মাটি পেতে হলে আপনাকে নিচে নামতে হবে ১৩+২১=৩৪ তলা ! মানে প্রায় ১০৫ মিটারের বেশি লম্বা হতে হবে ! এখানেই শেষ নয়। নদীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন গভীরতার স্কাউর হতে পারে এজন্যে ফ্যাক্টর অফ সেফটি রাখতে হয়।

এজন্য মোটামুটি এভারেজ ১২০ মিটার পাইল দেয়া হয়েছে। ১২০ মিটার মানে প্রায় একটা ৪০ তলা বিল্ডিং! এই ৪০ তলা বিল্ডিং এর সমান লম্বা পাইল, বসানো হয়েছে। এটা গেল পাইলিং এর গভীরতা !

পাইলিং বা পাইল এর সাইজ

পাইলিং গুলো সার্কুলার শেপ এর । অর্থাৎ গোল ৪০ তলা বিল্ডিং এর সমান লম্বা সিলিন্ডার ! এই সিলিন্ডারের ব্যাস হল ৩ মিটার। মানে প্রায় আপনার রুমের ফ্লোর থেকে ছাদ পর্যন্ত ! এটা হল ব্যাস !

পাইলিংগুলো বানানো হচ্ছে স্টিলের পাত দিয়ে। বেশ পুরু, প্রায় ৬০-৭০ মিলিমিটার। এই পাতগুলোকে সিলিন্ডার বানানো হয়েছে। এই সিলিন্ডার জ্যামিতিক হারে এটাচ করা হবে। মানে এক মিটার লম্বা সিলিন্ডারের সাথে, এক মিটার লম্বা আর একটা পার্ট। এবার এই দুই মিটার লম্বা সিলিন্ডারটার সাথে, আর এক একটা দুই মিটার লম্বা সিলিন্ডার। এভাবে ২০তলা বিল্ডিং এর সমান লম্বা একটার সাথে আর একটা ২০ তালার সমান লম্বা পাইল জোড়া দিয়ে বানানো হচ্ছে একটা পাইলিং !

পাইলিং বা পাইল কনস্ট্রাকশন

এই যে বিশাল লম্বা পাইলগুলোর জন্যই জার্মানি থেকে স্পেশাল হ্যামার (হাতুড়ি) আনা হয়েছে। স্পেশাল ক্রেন, স্পেশাল হ্যামার ! এই পাইলগুলো ফাঁপা। মাটিতে বসানোর পর, এদের মাঝে স্যান্ড দিয়ে ফিল করা হবে। পাইলিং গুলোতে জং ধরতে পারে, যদিও বা ধরে ১০০ বছরে ক্ষয় হবে ১০ মিলিমিটার। ৫০/৬০ মিলিমিটার তখনো থাকবে। (এটা টেস্টেড, কতটুকু ক্ষয় হবে জং ধরলে) পদ্মা সেতুর ডিজাইন লাইফ ১০০ বছর।

পাইলিং বা পাইল সংখ্যা

এই জন্য প্রতি কলামের নিচে ৬টা করে পাইলিং থাকবে। মাকড়শার যেমন ৮টা পা ৮দিকে থাকে, এই পিয়ারের (কলামের) পাইলিং গুলো তেমন ৬ দিকে ছড়ায়ে যাবে। পাইল গুলো ভার্টিক্যাল ভাবে কিন্তু মাটিতে বসানো হবে না। বাঁকা করে, ইনক্লাইন্ড ভাবে ঢুকানো হবে। ওয়ান এইচ:সিক্স ভি অনুপাতে ইনক্লাইন্ড হবে। তো ১২০মিটার লম্বা পাইল, বাঁকা করে ঢুকালে মাটির নিচে এদের ৬জনের পা, ৬দিকে অনেক অনেক দূরে থাকবে। এই ৬দিকের মাটি একসাথে ধুয়ে যাবে না (স্কোর হবে না)।

পাইলিং বা পাইল ক্যাপ

৬ টা পাইলিং এর মাথায় থাকবে পাইলিং বা পাইল ক্যাপ। এই জিনিসটা আপনি পানিতে ভেসে থাকতে দেখবেন। কিন্তু এটা মোটেও ভেসে নেই ! এটা রীতিমত ৬ পাইল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পাইল ক্যাপ এত বড়, একটা ৩/৪ জনের ফ্যামিলি এতটুকু জায়গায় সংসার করতে পারবে ! একটা খুবই রাফ এস্টিমেসন বলে, এখানে ৯০০ স্কয়ার ফিটের বেশি জায়গা আছে ! মানে একটা পাইল ক্যাপ ৯০০ স্কয়ার ফিটের চেয়ে বড়। এই পাইল ক্যাপ পুরোটাই কংক্রিটের।

কংক্রিট পাইলিং বা পাইল

দুইটা পিয়ারের নিচের পাইলিং বা পাইল একটু অন্য রকম হবে। ভার্টিকেল বরেড কংক্রিট পাইলিং বা পাইল হওয়ার কথা। যেগুলো ৮০ মিটার পর্যন্ত গভীরে যাবে। মানে এই পাইলিং বা পাইলগুলো ইনক্লাইন্ড হবে না, সোজা পানির নিচে যাবে। এগুলো হবে কংক্রিটের পাইলিং বা পাইল, আমাদের বাসা-বাড়ির সাধারন কলামের মত। এই পাইলিং বা পাইল গুলো পানিতে কাস্ট করা হয়েছে !

ব্রিজ পিয়ার

পাইলিং বা পাইল ক্যাপের উপর দাড়িয়েছে পিয়ার বা ব্রিজের কলাম। এই পিয়ার পুরোটাই কংক্রিটের। রেইএনফরসেট কংক্রিট। পুরো ব্রিজে ৪১ টা পিয়ার হয়েছে ।

পদ্মা সেতুর স্প্যান

এই পিয়ারের মাথায় বসেছে স্প্যান। প্রতিটা স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। এই স্প্যান ডিজাইনের জন্য, ৩ ধরণের স্প্যানের এনালাইটিকাল মডেল (কম্পিউটার এ, এনালাইসিস সফটওয়্যার দিয়ে) বানিয়ে চেক করা হয়, কোনটা সবচেয়ে কম খরচে বেশি সেফটি দিবে। তিনটা স্প্যান ছিল : ১২০ মিটার, ১৫০ মিটার আর ১৮০ মিটার। এদের মধ্যে ১৫০ মিটার স্প্যান ছিল সবচেয়ে ইফসিন্ট তাই বাস্তবে ১৫০ মিটার স্প্যান বসানো হয়েছে।

পদ্মা সেতুর পাইল এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে জামিলুর রেজার এক সাক্ষাৎকারে এজন্যেই বলেছেন, আমরা যে পাইলিং বা পাইলগুলো করছি সেটি একটি বিশ্বরেকর্ড।

add-content

আরও খবর

পঠিত