নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( স্টাফ রিপোর্টার ) : রোগী আছে ডাক্তার নেই, অথবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। অনাকাঙ্খিত আচরণ সহ ঠিকমত সেবা দেন না আয়া, নার্স বা চিকিৎসকরা। সব মিলিয়ে প্রতিদিনই উঠে আসছে নতুন নতুন অভিযোগ। চিকিৎসা সেবা নিয়ে এছাড়াও নানা অভিযোগ নতুন নয়। নারায়ণগঞ্জের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা এখন এতটাই করুণ দশা যে, দূষিত, নোংরা পানিতেই ধোয়া হচ্ছে সরকারী হাসপাতালের রোগী, নার্স ও ডাক্তারদের বিছানাপত্র এবং অ্যাপ্রোনসহ ব্যবহৃত সমস্ত কাপড়। তবে এ ব্যপারে জানেন না নারায়ণগঞ্জের অন্যতম দুইটি সরকারী হাসপাতাল- খানুপর ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল ও ১০০ শয্যা বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেনারেল ( ভিক্টোরিয়া ) হাসপাতাল।
অনুসন্ধানে শহরের ইসদাইর এলাকার একটি পরিত্যক্ত ডোবার সামনে গিয়ে এমনই করুন দৃশ্য দেখা গেল। সরকারী হসপাতালের রোগীর মলমূত্র, পুঁজ আর রক্তমাখা এসব কাপড় চোপড় কোনোমতে পরিষ্কার করে ধূলিকণা আর নোংরা পরিবেশেই শুকানো হচ্ছে খোলা জায়গায়। ছোট্ট একটি ময়লাযুক্ত ডোবা পানিতে ধোয়া হচ্ছে সরকারী হাসপাতালের কাপড়-চোপড় সামগ্রী। হাঁটু পর্যন্ত ময়লা আর নোংরা পানিতে পা দিয়ে তা ভিজিয়ে নিচ্ছেন ধোলাইখানার লোকজন। নোংরা পানিতে ভাসছে পোকা, ক্যামিকেলের বর্জ্য, মুরগীর পাখা। আর এর পাশেই রয়েছে একটি গরুর খামারও। আবর্জনার স্তপ থাকায় কুকর বিড়ালের রয়েছে অবাধ বিচরণ। দুর্গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে সেখানকার পরিবেশ। তবুও বছরের পর বছর এভাবেই চলছে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে হাসপাতালের কাপড় পরিচ্ছন্নের কাজ।
ঘটনাস্থলে সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেতেই সেখান থেকে চলে যায় ধোপীরা। তবে নোংরা পানিতেই একজন মহিলা ধোপী কাপড়-চোপর ধোয়ার কাজ করে যাচ্ছিলেন। আবার এসব কাপড়ই জীবাণুসহ নোংরা অবস্থায় রোগীদের ব্যবহারের জন্য দেয়া হচ্ছে। বাদ যায়নি (ওটি) অপারেশন থিয়েটারের মত স্পর্শকাতর স্থানের চিকিৎসকদের ব্যবহৃত অ্যাপ্রোন ও পাজামা সহ অন্যান্য কাপড়। দিনের পর দিন এসব জীবাণুবাহী অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করায় এগুলোর সরাসরি প্রভাব পড়বে রোগীসহ সংশ্লিষ্টদের ওপর। রোগ সারাতে এসে কেউ কেউ নতুন করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে না, সেটাও বলার উপেক্ষা রাখেনা। এসব ধোয়ামোছা করছে যারা তারাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শ্রমিকদের হাত-পা দিয়ে বের হচ্ছে পুঁজ । এ এক ভয়ংকর পরিস্থিতি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ প্রসঙ্গে একজন ধোপী জানায়, নারায়ণগঞ্জ (ভিক্টোরিয়া) ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ব্যবহৃত করা হয় এসব কাপড়। টেন্ডারের মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে এগুলোর দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। পরে তাদের কাছে পরিস্কার করার জন্য আমাদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, কোনো শ্রমিকই পুঁজ ও রক্ত মেশানো এ নোংরা পানিতে নেমে কাপড় পরিষ্কার করতে চায় না । যেহেতু লন্ড্রী থেকে চুক্তিবদ্ধভাবে তাদের এসব কাপড় দেয়া হয়। পেটের দায়ে করতে হয়। বিষাক্ত পানির প্রভাবে তাদের পা ও হাতে ঘা হয়, পচন ধরে। প্রায় ক্ষতের স্থান দিয়ে পুঁজ পড়ে। এসব পুঁজ ওই পানিতেই মিশে, যে পানি দিয়ে এসব ধোয়া হচ্ছে। প্রায় শতাধিক রোগীর ব্যবহৃত মলমূত্র পুঁজ ও রক্তমাখা চাদর, ফতুয়া, পাজামা, অপারেশন বেডসিট ইত্যাদি কাপড় তাদের পরিস্কার করতে হয়।
বিভিন্ন সময় হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে দেখা গেছে, হাসপাতালের ভেতরেই বিড়াল দৌঁড়াচ্ছে। বেডের উপরে শুয়ে আছে মানুষ, নীচে যেন বিড়াল আর মশা-মাছির বসতি। চরম এই দৈন্যদশা দেখারও যেন কেউ নেই। বিছানার চাদরে লেগে আছে কালচে দাগ, কোথাও রক্তের দাগ। আবার কোনোটা কুঁচকানো, কোনোটা ছেঁড়া। এমনও দেখা গেছে, রোগী হাসপাতালে ভর্তির পর যতদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন, সঠিক সময়ে বেডশিট আর বদলানো হয়নি। সরকারি হাসপাতালে এ অবস্থার জন্য হাসপাতালের সক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী এবং দেখভালের সঙ্গে জড়িতদের অবহেলাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বর্তমানে সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে অনেকটাই সু ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির আওতায় চলে আসছে বেসরকারী সহ সরকারী হাসপাতাল। তারপরেও কিছু হাসপতাল কর্তৃপক্ষের উদাসিনতায় স্বাস্থ্য ঝুকিঁতে পড়েছে রোগী সহ খোদ চিকিৎসকরাও।
এ ব্যপারে স্থানীয় বাসিন্দা ও ইসদাইর রাবেয়া হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরেই এখানে হাসপাতালের রোগীদের বেডের চাদর ও চিকিৎকের এপ্রোন সহ বিভিন্ন কাপাড় ধোয়া হচ্ছে। এভাবে পচা পানিতে কাপড় ধোয়া হলে রোগী সহ ডাক্তাররাও অসুস্থ্য হয়ে যবে। আর খোলা জায়গায় শুকানো হচ্ছে এসব কাপড়। এগুলোর ভাইরাসে আমাদের শিক্ষার্থী ও এলাকবাসীর অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ (ভিক্টোরিয়া) ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আরএমও আসাদুজ্জামানের সাথে কথা হলে তিনি জানায়, আমরা টেন্ডারের মাধ্যমে এসকল কাপড় দিয়ে থাকি। কিন্তু এভাবে অপরিচ্ছন্ন স্থানে সরকারী হাসপাতালের কাপড় চোপড় ধোয়া হয় তা জানা নেই। আমি খোঁজ নিবো। কারণ আমাদের বেশীর ভাগ কাপড়ই নিজেদের লোক দিয়ে পরিস্কার করিয়ে থাকি। এসময় তিনি এড়িয়ে গিয়ে খানপুর হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্ন করলে প্রতিবেদক তাকে কাপড় পরিচ্ছন্ন কাজের সংশ্লিষ্টদের কথা জানায়। যিনি ওইসব কাপড়গুলো ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের বলেই জানিয়েছেন।
তারপরেও উনার কথার সূত্র ধরেই যাওয়া হয় খানপুর নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। অফিসে না থাকায় মুঠোফোনে এ ব্যপারে কথা হয় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোতালিব হোসেনের সাথে, তিনিও বিষয়টি এড়িয়ে যান। পরে উনার পিএ সিদ্দিকুর রহমানরে সাথে কথা বলার জন্য বলেন। সেখানেও যাওয়া হয়্। কথা হলে তিনি এ বিষয়টি জেনে দু:খ প্রকাশ করেন। তবে তিনিও এটি নিশ্চিত করেছেন এসব কাপড়গুলো টেন্ডারের মাধ্যমে দিয়ে দেয়া হয়। তারাই এই কাজগুলো সম্পাদন করেন। ওই সময় তিনি আশংকা প্রকাশ করেন, এসব নোংরা কাপড় যদি আমরা পড়ি তাহলেতো আমরাও রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ্য হয়ে পড়বো।
এ ব্যপারে ৩০০ শয্যা হাসপাতালের কাপড় চোপড় ধোয়ার চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদার মাহবুবুর রহমান মারুফ জানান, আমাদের ধোলাই কাজের দেখাশোনা করেন মামুন ও করিম। নোংরা পানিতে কাপড়গুলো ধোয়ার কথা আমার জানা নেই। এ কাপড় তো ডাইংয়ে ধোয়ার কথা। তিনি এ ব্যপারে খো৭জ নিবেন বলে জানান।