নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( রূপগঞ্জ প্রতিনিধি ) : শূন্য দৃষ্টিতে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কথা বলতে চাইলে তার দুই চোখ বেয়ে অঝোড়ে পানি ঝড়তে থাকে। মাঝে মধ্যে কেবলই মা মা বলে কেঁদে উঠছে। মুখে কোন কথা নেই। কিন্তু তাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা যেন আশপাশের কারো নেই। স্বজন বলতে কেই নেই এক মামা ছাড়া। বাড়ির অনেকেই সান্তনা দিতে গিয়ে উল্টো তারাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। এ দৃশ্য নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল আনোয়ার হোসেনের ভাড়াটিয়া বাড়িতে। হাসেম ফুটস এন্ড বেভারেজ কারখানার অগ্নিকান্ডে তার মা ফিরোজা বেগমকে হারিয়ে এক প্রকার বাকরুদ্ধ কিশোরী সুমাইয়া (১৩)। ফিরোজা বেগম তার একমাত্র মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ ধরে আনোয়ারের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করে আসছে। সুমাইয়া ৫নং ক্যানেলের বর্ণমালা কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাই স্কুলের ৮ম শ্রেনীর শিক্ষার্থী।
ফিরোজা বেগমের ভাই লিটন মিয়া জানান, গত ১৬ বছর পূর্বে চাঁদপুর এলাকার জাহের মিয়ার সঙ্গে তার বোন ফিরোজা বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা জানতে পারেন জাহের মিয়া পূর্বেও আরেকটি বিয়ে করেছেন। বিয়ের তিন বছর পর সুমাইয়ার জন্ম হয়। এ বিষযটি জানাজানি হলে তাদের দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরে। জাহের মিয়া তার প্রথম স্ত্রীর কাছে চলে যায়। এর কিছুদিন পর সুমাইয়ার মা তাকে নিয়ে গোলাকান্দাইল এলাকায় ভাড়ায় বসবাস করে মেট্রো স্পিনিং মিলে কাজ শুরু করেন। গত এক যুগ কাজ করার পর গত ২৪ মে কর্নগোপ এলাকার সেজান জুস কারখানার যোগদান করেন।
মৃত্যুপূরী ভবন থেকে বেঁচে আসা লিফট অপারেটর রানা মিয়াসহ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেজান জুস কারখানার ৬তলা বিশিষ্ট ভবনের চতুর্থ তলায় অতি মাত্রায় তাপ থাকায় কোন শ্রমিক ১৫ দিনের বেশী কাজ করতেন না। তাই কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৫ বা ২০ দিন পর পর অন্যান্য ফ্লোর থেকে শ্রমিকদের ৪র্থ তলায় বদলী করতো। ফিরোজা বেগম মৃত্যুপুরী সেজান জুস কারখানার ৬ষ্ঠ তলায় কাজ করতেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনার দিন তাকে ৪র্থ তলায় বদলী করে নিয়ে আসেন সেজান জুস কারখানা কর্তৃপক্ষ।
বিকাল সাড়ে ৫ টায় আগুন লাগার পর সেজান জুস কারখানায় ৬ তলা বিশিষ্ট ভবনের ৩য় তলায় দাউ দাউ করে আগুনের লেলিহান শিখা তীব্রতা বেড়ে চলছে। তখনো উপরের তলায় কর্মরত অনেকেই বুঝতে পারেনি কি ভয়ঙ্কয় পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ৪, ৫ ও ৬ তলার ফ্লোরে। আগুনের তাপে আর ধোয়ায় নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে শ্রমিকরা বাঁচার জন্য দিকবিকিট ছোটাছুটি করছিলো। তৃতীয় তলায় আগুন লাগায় ও কলাপসিবল গেটে তালা বদ্ধ থাকায় উপরের তলা থেকে কেউ নিচে নামতে পারেনি। ফলে জীবন বাঁচাতে অনেকে ৪র্থ তলা থেকে লাফিয়ে পরছিলো এমন একটি ভিডিও এসেছে যা দেখলে মনে হবে কোন বিদেশী ছবির শুটিং চলছে। কিন্তু না এটা ছিলো রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানার সেই মৃত্যুপুরীর প্রকৃত চিত্র।
প্রাণ বাঁচাতে অনেকে একের পর এক লাফিয়ে উপর থেকে পড়ছে। আর আটকে পরা গণবিবাদী চিৎকার যেন জানান দিচ্ছিলো এক চরম অসহায়ত্বের। আগুনে ঝলসে মৃত্যুর চেয়ে যেন নিচে লাফিয়ে পড়া যেন ছিলো শ্রেয়। বাঁচার আশায় অনেকে ৬ তলার ছাদ থেকেও লাফিয়ে পরে পাশের একটি টিন সেটের চালের উপর আবার কেউ বা সরাসরি মাটিতে। এখনো সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি মনে পরলে আতকে উঠে বেঁচে আসা শ্রমিক ফাতেমা, নাজমা, শিউলিসহ অনেকের।
ফিরোজা বেগমের ভাই লিটন মিয়া আরো জানান, আগুন লাগার পর আনুমানিক ৬ টার দিকে ফিরোজা বেগমের মোবাইল ফোন থেকে কান্না জড়িত কন্ঠে তাকে ফোন করে বলেন, ভাই আমাদের এখানে আগুন চলে এসেছে তুমি আমাকে বাঁচাও। এর পর থেকে লিটন মিয়া তার বোনকে অনেক বার ফোন দিলে সেখান থেকে তার ফোন রিসিভ হচ্ছে না। ততক্ষনে হয়তো ফিরোজা বেগম আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।