নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( বন্দর প্রতিনিধি ) : বন্দরে জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ-জেএমবির তিন জঙ্গিকে আটক করেছে র্যাব। বন্দর থানাধীন সোনাকান্দা এলাকা থেকে র্যাব-১১ এর একটি আভিযানিক দল জান্নাতুল নাঈম মিতু (১৯) তার দুই সহযোগী মেহেদী হাসান মাসুদ (২২), আকবর হোসেন সুমন (৩০) কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে উগ্রবাদী বই ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়। অভিযানকালে মিতুর ০২ বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তারকেও উদ্ধার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতুল নাঈমা মিতু জানায় যে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ফেইসবুক আইডি আল্লাহর সৈনিক এর মাধ্যমে জনৈক মেহেদী হাসান মাসুদের সাথে তার পরিচয় হয়। মেহেদী তাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কাজ করার আহবান জানিয়ে জসিম উদ্দিন রাহমানির উগ্রবাদী বক্তব্য সম্বলিত বিভিন্ন বক্তব্য সরবরাহ করে। এ প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে সে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হলে তাকে জেএমবির দাওয়াত দেয়। এছাড়াও নামায আদায় না করলে ও দাঁড়ি না রাখলে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করা উচিত বলে বিভিন্ন ফতোয়া প্রদান করে। মেহেদী হাসান মাসুদ তাকে বাংলাদেশ সরকার ও ত্বাগুত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হওয়ার আহবান জানালে জান্নাতুল নাঈম মিতু তাতে সাড়া দেয়। এরপর থেকে মিতু তার ফেইসবুক আইডি এসো ইসলামের পথে এবং আলোর পথ ইসলাম থেকে বিভিন্ন যুদ্ধ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্থিরচিত্র এবং ভিডিও সহ বিভিন্ন উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকে।
সে তার কাছের বন্ধু-বান্ধবদের কথিত জিহাদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করে। জান্নাতুল নাঈম মিতু তার স্বামী জুয়েলকে উগ্রবাদের পথে আসার আহবান জানিয়ে ব্যর্থ হলে স্বামীকে ত্যাগ করে কথিত শহীদি মৃত্যু বরণ করার লক্ষ্যে হিযরত করার পরিকল্পনা করে। তার পরিকল্পনার কথা মেহেদী হাসান মাসুদকে জানালে সে তাকে মাহরাম ছাড়া হিযরত করা যাবেনা বলে জানায় এবং তার বন্ধু আকবর হোসেন সুমনকে মাহরাম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়। এরপর মেহেদী তার বন্ধু আকবর হোসেন সুমনের সাথে মিতুর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সুমনকে মাহরাম হিসেবে পাওয়ার জন্য জান্নাতুল নাঈম মিতুু তার স্বামী জুয়েলকে ডির্ভোস দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
সুমন ও মেহেদীর পরামর্শ অনুযায়ী জান্নাতুল নাঈম মিতু ৩১ মার্চ সোনারগাঁয়ে তার নিজ বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে যায়। সুমন ও মেহেদী তাকে সেখানে একটি ভাড়া বাসা ঠিক করে দেয়। তারা দুজনে জান্নাতুল নাঈম মিতুকে শহীদ হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল ও পরামর্শ প্রদান করে এবং জান্নাতুল নাঈম মিতুুকে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে। পরে তারা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকার কয়েকজন জেএমবি সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা নেয়। এ লক্ষেই তারা নারায়ণগঞ্জে একত্রিত হয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
উল্লেখ্য যে, মিতু ২০১৭ সালে মেঘনা শিল্পনগরী স্কুল এন্ড কলেজ, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ হতে এসএসসি পাশ করেছে এবং একই কলেজে এইচএসসি অধ্যয়নরত।
মো. মেহেদী হাসান মাসুদ(২২), চট্টগ্রাম হতে ৫ম শ্রেনী পাশ করে। সে ২০১১ সাল হতে চট্টগ্রামের হালিশহর ও ইপিজেড এলাকায় একটি ফুড প্রোডাক্টস্ কোম্পানীতে সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে চাকুরী করে। ২০১৫ সালে সে জনৈক সামি ভাই এর মাধ্যমে হানাফি থেকে সালাফি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়। এরপর উক্ত সামি ভাই তাকে উগ্রবাদী বিভিন্ন বয়ান শুনতে ও কিছু বই পড়তে দেয়। পরবর্তীতে এ সকল বয়ান ও বইয়ের মাধ্যমে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে সে বিভিন্ন সালাফি মসজিদে যাতায়াত শুরু করে।
২০১৫ সালের শেষদিকে সামি তাকে অপর এক দ্বীনি ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এসময়ে সে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জেএমবির কর্মী সংগ্রহ করেছে। ২০১৮ সালে সে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁয়ে সফর করে বিভিন্ন গোপন মিটিং ও জেএমবির কর্মী সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিল। সে বিভিন্ন সময়ে দ্বীনি বোনদেরকে পর্দার আড়াল থেকে জেএমবির আদর্শিক বয়ান প্রদান করত এবং বাংলার মাটিতে জিহাদ কায়েম করার জন্য একনিষ্ঠভাবে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাত। এর সুবাদে একাধিকবার মিতুর সাথে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় মেহেদীর দেখা হয়। মেহেদী সরাসরি দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করত।
মো. আকবর হোসেনসুমন(৩০), ২০১৬ সালের শেষ দিকে এই চাকুরীর সুবাদে অপর একটি ফুড প্রোডাক্টস কোম্পানীর সেলস্ ম্যানেজার মেহেদী হাসান মাসুদ এর সাথে তার পরিচয় হয়। এই পরিচয়ের মাধ্যমে মেহেদী হাসান মাসুদ, সুমনকে উগ্রবাদের দাওয়াত দেয় এবং তাকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই পড়তে ও উগ্রবাদী বয়ান শুনতে বলে।
এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারনা দিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সুমন জেএমবির সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপর সুমন এবং মেহেদী একত্রে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের কাজ করে। সে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের উস্কানীমূলক বক্তব্য ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করে সকলকে জঙ্গী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করাসহ নিজেকে ইস্তেশহাদির জন্য প্রস্তুত করে। মেহেদীর মাধ্যমে মিতুর সাথে সুমনের পরিচয় হয়। সুমন মিতুকে হিযরত করে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন প্রকার অপব্যাখ্যা প্রদান করে। সে এ পর্যন্ত ১০-১২ জনকে জেএমবির আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
জান্নাতুল নাঈম মিতু হিযরত করে চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর সে ও মেহেদী হাসান মাসুদ মিলে মিতুকে বাসা ভাড়া করে দেয়। পরবর্তীতে সুমন ও মেহেদী মিতুকে নিয়ে কর্মী সংগ্র্রহ করাসহ পরিচিত জেএমবি সদস্যদেরকে হিযরতে আহবান করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা করে নারায়ণগঞ্জে আগমন করে।