না.গঞ্জে নির্বাচন : পুরনোতে আস্থা, সোনারগাঁয়ের নতুনের গুঞ্জন

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েকদিন। তফসিল অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টার পর প্রার্থীরা আর কোনো সভা-সমাবেশ, নির্বাচনী গণসংযোগ, শোভাযাত্রা, মিছিল করতে পারবেন না। কারণ ভোট গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগেই বন্ধ হবে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার। নারায়ণগঞ্জের ৫ টি আসনে মোট ২২ লাখ ৫০ হাজার ৬৯১ জন ভোটার আগামী ৫ বছরের জন্য সংসদে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। কোন প্রার্থীকে কেন ভোট দিবেন তা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছেন ভোটাররা। সরেজমিন ঘুরে ভোটারদের সাথে কথা বলে কারা কারা ভোটের মাঠে এগিয়ে আছেন তার একটি ধারনাও পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জে ভোটের মাঠে একটি আসন ছাড়া বাকি আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যদের উপরই ভরসা রাখতে চাইছেন ভোটাররা।

ভূমিদস্যু ইস্যুতে এগিয়ে গোলাম দস্তগীর গাজী
নারায়ণগঞ্জের ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে ভোটের মাঠে ৯ জন থাকলেও সবার দৃষ্টি দুই ‘হাই প্রোফাইল’ প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ও তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকারের দিকে। এখানে আছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়াও। রূপগঞ্জ আসনে নির্বাচনের শুরুতে ত্রিমুখী লড়াইয়ের কথা উঠলেও ছিটকে পরেছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব। এখানে গোলাম দস্তগীর গাজীর সাথে মূল লড়াইটা হবে শাহজাহান ভূঁইয়ার। তবে দেশের একটি প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ী গ্রুপের আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়া এমন গুঞ্জনে সাধারণ ভোটারদের সমর্থন হারিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, সবসময় ‘ভূমিদস্যু’ আতঙ্কে থাকেন রুপগঞ্জবাসী। গোলাম দস্তগীর গাজীর অভিযোগ সেই , ‘ভূমিদস্যুরা পুতুল এমপি বানিয়ে’ এবার রূপগঞ্জকে দখল করতে চায়। গাজীর এই মন্তব্যের প্রভাব পড়েছে রূপগঞ্জের সাধারণ ভোটারদের মাঝে। তারা পুনরায় ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের আতঙ্কে ভুগছেন। স্থানীয়রা বলছেন, গোলাম দস্তগীর গাজী স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকায় অনেকটায় সংযত ছিল ভূমিদস্যুরা। তাকে সরাতে পারলে রূপগঞ্জ ভূমিদস্যুদের কবলে চলে যাবে। এতদিন যেসব জমি রাতের আঁধারে গোপনে ভরাট হতো সেই কার্যক্রম আগামীতে প্রকাশ্যে দিবালোকে হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। রূপগঞ্জে তাই ভোটের অঙ্কে ‘ভূমিদস্যু’ ইস্যুতে এগিয়ে গোলাম দস্তগীর গাজী

বাবুকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্যর্থ প্রতিদ্বন্দ্বীরা
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫ জন প্রার্থী। এখানে শক্ত অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্যসহ নজরুল ইসলাম বাবু। মাঠে আলোচনায় থাকলেও ভোটারদের মধ্যে প্রত্যাশিত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছেন জাতীয় পার্টির আলমগীর সিকদার লোটনসহ অন্য প্রার্থীরা। তাই পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পথে নজরুল ইসলাম বাবু।

পরপর তিনবারের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে তাঁর একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীদের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারেননি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এমনটাই মত স্থানীয়দের। পারলে এখানে জমজমাট একটি নির্বাচনী লড়াই হতে পারতো বলে জানিয়েছেন তারা।

এখানে বাবুর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে থাকা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটনের পারিবারিক ভোট ব্যাংক এবং জাতীয় পার্টির ভোটের পাশাপাশি সরকার বিরোধী ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বড় ব্যবধানে জয় পাবেন নৌকার প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবু।

সোনারগাঁয়ে পরিবর্তনের হাওয়া
সোনারগাঁয়ে ভোটের মাঠে ৭ জন প্রার্থী থাকলেও মূল লড়াই হবে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা ও সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আব্দুল্লাহ আল কায়সারের মধ্যে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিললেও সোনারগাঁয়ের মানুষ এবার পরিবর্তনের পক্ষে। বাসিন্দাদের দাবি ক্ষমতাসীন দলের এমপি না থাকায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি এই আসনে। তাই এবার সরকার দলীয় প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল কায়সারকে চাচ্ছেন ভোটাররা। এমনকি নিজ দলের নেতাকর্মীরাও লিয়াকত হোসেন খোকাকে ত্যাগ করে কায়সার হাসনাতের শিবিরে যোগ দিয়েছেন। তাই ভোটের হিসেবনিকেশে অনেকটাই এগিয়ে আব্দুল্লাহ আল কায়সার।

তবে কায়সার হাসনাতকে মোকাবেলা করতে হবে ‘মুখে কায়সার বুকে খোকা’ গুঞ্জনকে। কারণ এই আসনে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের ‘প্রভাব’ রয়েছে। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা শামীম ওসমানের রাজনীতি করেন। বর্তমান সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা শামীম ওসমানের বন্ধু এবং ওসমান পরিবারের ‘বিশ্বস্ত’। তাই শেষ মুহূর্তে এই আসনে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’কে বাদ দিতে চাচ্ছেন না রাজনীতি বিশ্লেষকরা। এমন কিছু ঘটলে শেষ হাসি হাসবেন লিয়াকত হোসেন খোকা।

শক্তিশালী ওসমান ভাতৃদ্বয়ের সাথে দুর্বল ‘খেলোয়াড়রা’
‘খেলা হবে’ বলে শ্লোগান দেয়া নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শামীম ওসমান ও তার বড় ভাই এ কে এম সেলিম ওসমান নির্বাচনের মাঠে নামার আগেই জয় নিশ্চিত করেছেন বলে মত বিশ্লেষকদের। তাঁদের দুইজনের আসনেই নেই কোন পরিচিত মুখ কিংবা রাজনৈতিক দল। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম ওসমানের বিপরীতে প্রার্থী ঘোষণা করেনি আওয়ামী লীগ আবার নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে শামীম ওসমানকে ‘ছাড়’ দিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সালাউদ্দিন খোকা মোল্লা প্রার্থিতা প্রত্যহার করেছেন বলে মত অনেকের। তাঁদের দুইজনের বিপরীতে যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের কিংবা তাদের দলের বিশেষ পরিচিতি ভোটারদের মাঝে নেই। তাই তাদের নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণা দেয়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্র আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক কর্মীরা।

জয়ের ব্যাপারে নির্ভার হলেও ভিন্ন চ্যলেঞ্জে আছেন দুই ভাই। তাদের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা বলছেন, শুধু জয় নয় বিপুল ভোটে জেতায় এখন তাদের চ্যালেঞ্জ। তাই বেশি সংখ্যক ভোটারদের কেন্দ্রে আনাটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন এই দুই সংসদ সদস্যের নেতাকর্মীরা।

নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের শামীম ওসমানসহ আট জন প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছেন। শেষ দিনে এই আসনে জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ছালাউদ্দিন খোকা মোল্লা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কাগজে-কলমে আসনটিতে তৃণমূল বিএনপি, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিসহ আরও সাত জন প্রার্থী থাকলেও তারা তিন বারের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের শক্ত প্রতিদ্বদ্বী হয়ে উঠতে পারবেন না বলেই মনে করছেন স্থানীয়রা।

একই পরিস্থিতি শামীম ওসমানের বড় ভাই নিট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমানের নির্বাচনী আসনেও। এই আসনে তৃণমূল বিএনপি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির তিন জন প্রার্থী থাকলেও তারা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম ওসমানকে হারানোর মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নন। আসনটিতে শুরু থেকেই কোনো প্রার্থী দেয়নি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। যদিও সদর ও বন্দর থানা নিয়ে গঠিত এই আসনটিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও নবীন রাজনীতিক প্রার্থী হতে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন।

তবে জেলার ৫ টি আসনের মধ্যে রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে কোন অঘটন ঘটে কিনা তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভোটের দিন পর্যন্ত। কারণ এই দুইটি আসনের প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারিদের ভোটের মাঠের পাশাপাশি অদৃশ্য শত্রুদেরকেও মোকাবেলা করতে হবে। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বড় ধরনের ‘শিবির বদল’ এর ঘটনা ঘটতে পারে এই ২ টি আসনে। তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ জানুয়ারি রাত পর্যন্ত।

add-content

আরও খবর

পঠিত