নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিক শুভ্র হত্যার পাঁচ বছর, পিতার আক্ষেপ

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : তরুণ সাংবাদিক ও সংগঠক শাহরিয়াজ মাহমুদ শুভ্র। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের বড় ছেলে। শত চ্যালেঞ্জিং হলেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল সাংবাদিকতা। সে সরকারী তোলারাম কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। বাবা-মায়ের বড় ছেলে হওয়ার সুবাধে দায়িত্ববোধটা সেই ছোট থেকেই। তাই বাড়তি খরচতো দূরের কথা। যতটা পারতো টাকা সাশ্রয় করে চলতো। পাশাপাশি টিউশনি করে সে তার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে বাবাকে সহযোগীতা করতো।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাতে ফতুল্লার লালপুরের বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে বের হয় শাহরিয়াজ মাহমুদ শুভ্র। পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুঁইগড়ের একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১০ সেপ্টেম্বর জামা কাপড় দেখে লাশটি শাহরিয়াজের বলে শনাক্ত করে তার বাবা-মা। পরে শুভ্র হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  তারা হলো, ইয়ামিন ওরফে আল আমিন, জালাল, জুয়েল ও রবিন। যাদের মধ্যে দুইজনই প্রকৃতির বিচারে জেল হাজতে অসুস্থ হয়ে ইহকাল ত্যাগ করেছেন।

দেখতে দেখতে সেই শুভ্র হত্যার যেন চলে গেল ৫টি বছর। তবে ছেলের শোকে মাতম এখনো তার পরিবার। তাই ছেলেকে নিয়ে প্রতিবছরই আক্ষেপ জানান তার পিতা কামাল সিদ্দিকী । বৃহস্পতিবার ( ৮ সেপ্টেম্বর ) রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এবার তার লিখায় তোলে ধরেছেন শুভ্র হত্যাকান্ডের মামলা নিয়ে তার বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা। যা পাঠকদের জন্য হুবুহু তোলে ধরা হলো।

“ পাঁচ পাঁচটি বছর কেটে গেল তুমি নেই । শূন্য, হা হা কার- শোকের মাতম শুধুই  ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া  বিগত পাঁচ বছরে কিছুই পাইনি । ভিকটিম পরিবারগুলোর যন্ত্রণার লাভা ঘাম হয়ে ঝরে । তা দেখে অভ্যস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র তৃপ্তির হাসি হাসে। আইন -আদালত, বিচার- বিচারপতি কিছু অসাধু উকিল নামক কাকের দল, রাজনৈতিক নেতৃত্বের পিশাচী আচরন -আস্ফালন থেকে পরোক্ষ প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে  খুনের মাতাল নেশায় মত্ত খুনি বুক সটান রাজপথ ধরে জিঘাংসায় মেতে উঠে। যাপিত জীবনে পিষ্ট নাগরিক অব্যক্ত আর্তনাদে ছটফট করে কাটায় দিন। । কখন কার জীবনের শলতে ফুরাবে? কখন হানা দিবে ঘাতক-  আততায়ী ? ওরা আসে বন্ধু রূপে ; বন্ধুক হয়ে ফেরে। ওরা আসে নানা রূপে – না না নামে।  ছদ্মের আবরনে কখনো মদ্যমাতাল-চাঁদাবাজ। কখনো ছিনতাই কারী- কখনো  উঁচু তলার বিলাসী দুলালের খায়েশ বরদার রূপে।  খুনি সে যে নামেই আসুক । যে ভাবেই হাসুক।

না , এখন আমাদের কোন কষ্ট নেই । যন্ত্রণা নেই । নেই বিচার পাবার আর্জি । কত বিচারের প্রহসন বহায় কালের স্রোত । পরম বন্ধুর দায় সারা মিথ্যা সাক্ষ্য বিচারককেও বিস্মিত করে। সকলে কান পেতে শোনে মিথ্যার স্লোগান কীভাবে পবিত্র আদালত পাড়ায় সয়লাব হয় ! না ওদের দোষ নেই । ওরা মহাজনের শিকার – শেখানো বুলির তোতাপাখি ।

বাবা, এই পাঁচ বছরে কত খেলাইতো দেখলাম । বন্ধুরা,তোমার পরিবারের ছায়া হয়ে কতদিন ঘুরেছে। মিছিল মিটিং এ সরব থেকেছে । শুধুই একটু বাঁচার আকুতি নিয়ে । সন্দেহের তীর টাকে ডানে বামে ঘুরিয়ে দিয়ে শূন্যে ভাসানোর জন্য । কী আক্ষেপ ওদের আহ লাশ টা যদি ঘুম হয়ে যেত! যদি শনাক্তকারীদের মিস গাইড করা যেত!

কী বিচিত্র তাই না বাবা!

বিচিত্র সংসার থেমে থাকে না । থেমে থাকেনা জীবনের গান। হ্যাঁ, সব কিছু ঠিক এগিয়ে চলে । শুধু চলেনা বিচার কার্যক্রম । তারিখের পর তারিখ পড়ে। স্পিড মানির অভাবে আটকে থাকে সমন। যদিও চেষ্টার পর চেষ্টা করে সমন বের করা হলো মাননীয় আদালতের সিগনেচার এর পর এজলাস থেকে সে সমন গায়েব হয়ে পড়ে। বিব্রত পেশকার বিব্রত কতৃপক্ষ ।বলা হলো -“ঠিক আছে এই মামলার স্বাক্ষী আদালতে এলেই সাক্ষ্য নিয়ে নেয়া হবে । যান , সাক্ষী বায়াস করে নিয়ে আসেন। ”

সাক্ষী এলো কিন্তু আদালত আজ অপারগ । এমনি করে কাটে দিন – মাস- বছর। পিপি বদলায়, বিচারক বদলায় সাথে সাথে  বদলায় তাদের মেন্টালিটি। কিন্তু বদলায় না আমাদের বিচার পাবার আশা । আবার পরিচয় করো । পূরাতন রেকর্ড নতুন করে বাজাও । অচল কব্জায় তেল দিয়ে সচল করো। কিন্তু তেল তো শেষ । “তা হলে কীভাবে হবে ? আপনারা টাকা পয়সা দিয়ে চেষ্টা করুন । আমরা তো আছি!

বাবা কী অব্যবস্থা এই দেশের আইনি পাড়ায়। বড় বড় পণ্ডিত আইনজ্ঞ আইন প্রণয়ন করেন। সেই আইনি প্রক্রিয়ার ছত্রে ছত্রে অনিয়ম । তার যাঁতাকলে পিষ্ট ভিকটিম পরিবার। খুন হলো -মরদেহ পাওয়া গেল। অকুস্থল সূরত হাল রিপোর্ট তৈরি করা হলো। স্বাক্ষীর প্রয়োজন, যদু মধু  কুদু কে তাৎক্ষণিক সাক্ষী করা হলো । তাদের নাম ঠিকানা হ-য-ব-র-ল । কী বিচিত্র তাই না!  সাক্ষীর জবানবন্দি আগে থেকেই লিখিত। তোতা পাখির মত সে জবানবন্দি মুখস্থ কর তারপর বলো । এর ব্যতিক্রম হলে সর্বনাশ !

এই তো মানুষের গড়া আদালত । তার কত রকম ফের । হায় অভাগা স্বদেশ আমার ! আমরা স্বাধীন হয়েছি । কিন্তু আমাদের মানসিকতা এখনো স্বাধীন হতে পারেনি। প্রতি পদে পদে শৃঙ্খল। সব কিছুই লাল ফিতা আর উপর ওয়ালার রক্ত চক্ষুর উপর নির্ভরশীল । আসামী বা বাদি যেই হোক না কেন উভয়ই শোষণের শিকার । না বাবা, আমাদের দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই । এই কষ্ট শুধুই ভিকটিম পরিবারগুলোর । কী বিচিত্র মানুষ সব ! কে কখন কোথাও কিভাবে লাশ হবে কেউ জানে না । কিন্তু অন্য কে নিয়ে মাথাব্যথা । ওখানে এত রাতে কেন গেল? আরে ওরা তো ছিনতাই কারী হত্যা করতে চায়নি! নিছক ভুল বশত হত্যা করে ফেলেছে ।  ওদের সাথে বাড়াবাড়ি করা ঠিক হয়নি আপোষে ওদের পাওনা দিলেই তো হতো! না হত্যাকারীরা আসলে নির্দোষ । বেচারারা একটু নেশা করার জন্যই কাজটি করে ফেলেছে। ভিকটিমের  এমন ভুল করা ঠিক হয়নি। এমনি নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রশ্নের প্রলাপ বাক্য অহরহ শুনতে হয়।  আমরাও শুনতে শুনতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি ।

না বাবা আমরা মামলা করিনি কারণ তোমার শত্রু বা আমার শত্রুরা তোমাকে হত্যা করেনি। রাষ্ট্রের শত্রুরা হত্যা করেছে । রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে । তাই বিচারের দায়ভার একান্ত রাষ্ট্রের । কিন্তু রাষ্ট্রের উর্দীর নিচে ঘাপটি মারা কিছু দূর্নীতিবাজদের কারণে রাষ্ট্রের শত্রুরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । খুনিচক্র কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে । দলীয় পরিচয়, স্বজন প্রীতি, রাঘব বোয়ালী ঘুষ সর্বোপরি উপরি ওয়ালার আদেশ নির্দেশ এর ফ্রেমে বন্দি সকল চালিকা শক্তি । এখানে সকলে অসহায় -অসহায় বিবেক বোধ । আমাদের মর্ম যাতনা এক নিষ্ফল আর্তি । বেদনার ঘর। নির্বাক চাহনি অগোচরে লুকানো জল। ’’

add-content

আরও খবর

পঠিত