নারায়ণগঞ্জে রাজাকার পুত্রের অনুষ্ঠানে অতিথি মুক্তিযোদ্ধারা

নারায়ণগঞ্জ বার্ত ২৪ : বন্দর কলাগাছিয়া ইউনিয়নে শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও বার্ষিক ক্রীডা প্রতিযোগীতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বুধবার ২২ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় কলাগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকবেন দেশের সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ।

নিমন্ত্রণপত্র অনুযায়ী এতে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করার কথা রয়েছে- বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, এম.পি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে.এম সেলিম ওসমান। বিশেষ অতিথি হিসেবেও যিনি উপস্থিত থাকার কথা রয়েছেন তিনি হলেন বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ. রশিদ। অর্থাৎ এখানে বুঝার বাকি নেই, এখানে যারা সম্মানিত অতিথির তালিকায় রয়েছে তারা মুক্তিযোদ্ধা।

তবে প্রশ্ন উঠেছে নিমন্ত্রণপত্র উল্লেখিত তথ্যানুযায়ী এ অনুষ্ঠানে যিনি সভাপতিত্ব করবেন তাকে নিয়ে। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটিরও সভাপতি। তার নাম সেলিম রেজা। এছাড়াও তার পরিচয়ে উল্লেখ রয়েছে সাবেক রোটারী গভর্নর, বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। তবে আড়ালে পিতার বিষয়ে রয়েছে নানা অজানা কথা। আর এমন পরিবারের লোকদের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ হওয়ায় সাধারণ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দরে মাঝে উঠছে প্রশ্ন ও নানা গুঞ্জন।

সূত্র জানিয়েছে, সেলিম রেজার পিতা এম ওহাব একজন রাজাকার হিসেবেই পরিচিত। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বন্দর থানা শান্তি বাহিনীর সভাপতি ছিলেন এম এ ওহাব। আর তার পিতার নাম মরহুম অশ্রাফ আলী। তৎসময় তার বাড়িতে তার সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন করা হত। স্বাধীনতার পর তিনি এলাকার প্রভাব বিস্তার করে চলতেন। পরে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। সেই সময় প্রভাবশালী এই এম এ ওহাব এলাকার বিভিন্ন নীরিহ জনের সম্পত্তি কুট কৌশলে দখলে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে রেখে সেখানে মসজিদ মাদ্রাসা ইত্যাদি তৈরি করে নিজের অবস্থান মজবুত করে আমৃত্যু এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতো। সবশেষ ২০০৮ সালে তার মৃত্যু হয়।

কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানে পিতা না থাকলেও একই কায়দায় এলাকায় প্রভাব বিস্তাার করার পায়তারা করছেন তার বড় ছেলে সেলিম রেজা। আর এলাকায় নিজের অবস্থানের জানান দিতেই করা হয়েছে এতো বড় আয়োজেন। প্রায়শই সরকার দলীয় লোকদের সাথে করে তার রয়েছে ব্যপক সখ্যতা। আর তাই এই আয়োজনকে ঘিরে বন্দর উপজেলায় চলছে এখন ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা ঝড়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখক, ইতিহাসবিদ, গবেষক মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির নেতাদের তালিকা করেছেন। তাদের মধ্যে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’, ‘শান্তিকমিটি ১৯৭১’ ও রীতা ভৌমিকের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ’ বইয়ে নারায়ণগঞ্জের রাজাকারদের তালিকা পাওয়া যায়। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের অগ্রণী ভূমিকায় ছিল পাকিস্তানির দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির লোকজন।

তারাই সে সময় সাধারণ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। চালিয়েছে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম খন্ডে এবং রীতা ভৌমিক তার মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ বইতে ১৯৭১ এ নারায়ণগঞ্জে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজনৈতিক নেতা কর্মী সবাইকে এক কথায় যারাই মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেই সময়কার অনেক রাজাকার ও তাদের বংশধররা আজ রাজনীতিতে, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিলেন- এ এস এম সোলায়মান, এম. এ জাহের, সফর আলী ভুইয়া, আব্দুল বাসেত প্রমুখ।

সেখানে তালিকা ঘেটে পাওয়া যায়, ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকারের কমান্ডার ছিলেন। জায়েদ। নারায়ণগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ থানার দেওভোগ বাসিন্দা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। টুলু। নারায়ণগঞ্জের নারায়ণগঞ্জ থানার বাবুরাইলের বাসিন্দা টুলু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার ছিলেন।দেলোয়ার (দুলু) নারায়ণগঞ্জের নারায়ণগঞ্জ থানার জিমখানা এলাকায় রেলওয়ে কোম্পানির বাসিন্দা দেলোয়ার (দুলু)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার ছিলেন। আব্দুল জলিল।নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার আব্দুল জলিল ছিলেন একজন চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। আব্দুল বাসেত। নারায়ণগঞ্জের নারায়ণগঞ্জ থানার খানপুরের আব্দুল বাসেত ছিলেন একজন চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার ছিলেন। আমির আলী। নারায়ণগঞ্জ জল্লারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আমির আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

এমনি করে বন্দর উপজেলায় তালিকা থেকে পাওয়া যায় অনেকর নাম যার মধ্যে রয়েছে এম এ ওহাবের নামও। এরমধ্যে উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কুড়িপাড়া গ্রামের (ধামগড় ইউনিয়ন) রফিক ছিলেন এলাকার চেয়ারম্যান। বর্তমানে তিনি ঠিকাদার ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এম. ওহাব। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কলাগাছিয়া গ্রামের (ইউনিয়ন কলাগাছিয়া) এম. ওহাব ছিলেন একজন পাট-সার ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। কাশেম। বন্দর থানার মাহমুদনগর গ্রামের (ইউনিয়ন সোনাকান্দা) কাশেম ছিলেন একজন চাল ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এরপর খলিল। বন্দর থানার বন্দরের ৩৪ এইচ এম সেন রোডের বাসিন্দা খলিল। তার বাবার নাম আহসান উল্লাহ মুন্সী। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

এ বিষয়ে কথা হলে অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করার বিষয়টি স্বীকার করে সেলিম রেজা বলেন, অনুষ্ঠান হবে। এটা আমাদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান। এম ওহাব সাহেব আমার বাবা, তাতে কি। আমি আমার মত চলছি কোন সমস্যা নাই। আই ডোন্ট কেয়ার।

মুক্তিযোদ্ধের সময় স্বাধীনতা বিরোধী কাজের সাথে লিপ্ত ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা জেনে লাভ কি। আমি ব্যস্ত আছি। এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোকদের সাথে আপনার সখ্যতার গুঞ্জন চলছে। এ বিষয়ে তিনি জানান, বহু আগে থেকেই আছে।

এছাড়াও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ, শান্তিকমিটি ১৯৭১ ও রীতা ভৌমিকের লেখা মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ বইয়ে নারায়ণগঞ্জের রাজাকারদের তালিকায় তার পিতার নাম রয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানেন না বলেন। পরপরই বইয়ে থাকা নাম এবং ব্যবসার কথা জানালে তিনি স্বীকার করেন তার বাবা এম ওহাব এবং সার ব্যবসায়ী ছিলেন।

এদিকে এ বিষয়ে কথা হলে বন্দর উপজেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার কাজি নাসির বলেন, এম এ ওহাব কলাগাছিয়া এলাকার। উনি যে মুক্তিযোদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছেন এটা সকলেই জানেন। নতুন কিছু না। উনি একজন পাকিস্তানের দালাল ছিলেন। অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়েছি, তবে আমি যাচ্ছি না। আর এ অনুষ্ঠানের সভাপতি সেলিম রেজাই তার বড় সন্তান।

এম ওহাবের রাজাকারদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা নিশ্চিত করে সদর উপজেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এড. নুরুল হুদা জানান, হ্যাঁ উনি রাজাকার ছিলেন। এখানে কারা যাচ্ছেন আমি তো জানিনা। তবে রাজাকার পুত্রের অনুষ্ঠানে কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি গিয়ে থাকে, ভুল করবে। আমি এর তীব্র নিন্দা প্রকাশ করি।

এ প্রসঙ্গে জানতে আয়োজিত অনুষ্ঠানটির বিশেষ অতিথি উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ রশিদকে একাধিকবার কল দিলে তিনি রিসিভ না করায় কোন মন্তব্য জানা যায়নি।

add-content

আরও খবর

পঠিত