রূপগঞ্জে নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন, স্বজনদের আহাজারি

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( রূপগঞ্জ প্রতিনিধি, দুলাল ) : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা এলাকার সেজান জুস কারখানার অগ্নিকান্ডে ৯ই জুলাই শুক্রবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৫২ জনের দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঁচটি এ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ভবনের ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলায় এখনো আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আগুন লাগার পর কারাখানায় নিয়োজিত কর্মীরা ৪র্থ তলার কলাপসিবল গেটে তালা বদ্ধ করে দেয়ায় সেখানকার শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। দগ্ধ হয়েই ভবনের ফ্লোরেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন ৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫ টায় ৬ তলা বিশিষ্ট ভবনের তৃতীয় তলা থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্বজনরা শ্রমিকদের খুঁজতে এসেছেন। কারখানায় আগুন লাগার পর নিয়োজিত কর্মীরা ৪র্থ তলার কলাপসিবল গেটে তালা বদ্ধ করে রাখে। ছোট আগুন ও সহজেই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে এমন মন্তব্য করে শ্রমিকদের বের হতে দেয়া হয়নি। ভবন থেকে  বের হওয়ার বিকল্প সিঁড়ি কিংবা দরজা ছিল না। ভবন নির্মাণে বিল্ডিংকোর্টের অধিকাংশ শর্তই পালন করা হয়নি। কারখানায় কর্মরত থাকা শ্রমিকদের অধিকাংশই শিশু কিশোর ছিল। আগুন নিভানোর কোন ব্যবস্থা নেই। অগ্নি নির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার ছিলনা। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে কারখানায় দায়সারা পরিদর্শন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০ টায় বিভিন্ন অভিযোগে শ্রমিকদের স্বজনরা ক্ষিপ্ত হয়ে কারখানার অফিস কক্ষে ও নিরাপত্তাকর্মীদের লক্ষ্য করে  ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পার্শবর্তী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কর্ণগোপ এলাকায় তারা অবস্থান নেয়। গাড়ি ভাংচুর করে। নিরাপত্তাকর্মীদের বেদম প্রহার করে তাদের তিন জনের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পার্শবর্তী জলাশয়ে ফেলে দেয়। পরে দুটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

এ সময় পুলিশ ধাওয়া করে উত্তেজিত শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আগুনে ভবনের ফাটল দেখা দেয়। আগুনের তাপে কোন কেকান স্থানে লোহর রড গলে যায়। কারখানার ভেতরে দাহ্য পদার্থ ছিল। এছাড়া কারখানার কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্য, ঘি, বাটার, তেল, পলিব্যাগ, মবিল সহ দাহ্য পদার্থে আগুন স্থায়ী রূপ নেয়। এরকম নানা প্রতিকুলতায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা একটানা চেষ্টা চালিয়েও বিকাল সাড়ে ৫টায় এ সংবাদ  লেখা পর্যন্ত পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

কারখানায় আগুনের ঘটনায় সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন, নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের প্রতিনিধি, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ্ নুসরাত জাহান, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি ও কলকারখানা পরিদর্শক সহ ৭ সদস্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনে কমিটির সদস্য সংখ্যা বর্ধিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে, জেলা প্রশাসনের তহবিল থেকে নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। এছাড়া কারখানার মালিক পক্ষ থেকে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক হতাহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন।  ভবনের ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলার শ্রমিকদের কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েছেন। ১২জন শ্রমিককে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধার করেছেন।

এছাড়া অন্যান্য শ্রমিকদের এখনও খোঁজ মেলেনি। সেখানকার শ্রমিকরাও আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন বলে স্বজনরা আশংকা করছেন। নেত্রকোনা জেলার বাসিন্দা শান্তা মনি (১২) গত দেড় বছর ধরে এখানে চাকরি করেন। তার মা শিমু আক্তার মেয়ের খোঁজে বিলাপ করে কাঁদছেন। মাঝে মধ্যেই মূর্ছা যাচ্ছেন। এমনি করেই শ্রমিক পারভেজের (২০) মা ফরিদা, অমৃতার (২৫) স্বামী সেলিম মিয়া, রাবেয়ার (২০) পিতা চান্দু মিয়া, রহিমার (২৯) স্বামী কালাম মিয়াসহ আরো অনেকেই স্বজনদের জন্য আহাজারি করছেন।

এ সময় স্বজনদের খুঁজতে আসা মানুষের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। নিদারুণ এক দৃশ্য। কেউ ছুটছেন স্বজনের খোঁজে। শোকে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কেউবা বাক্ রুদ্ধ। কেউবা নিরবে দাঁড়িয়ে আছেন ভবনের পাশে। আবার কেউ কেউ মুর্ছে যাওয়া স্বজনদের পার্শবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। এরকম হৃদয় বিদারক দৃশ্য উপনিত হয় আশপাশের পুরো এলাকায়।

নিখোঁজ শ্রমিকদের খুঁজতে আসা স্বজনরা দ্বিকবিদিক ছুটাছুটি করেন। কেউবা উত্তেজিত হয়ে কারখানার কর্মকর্তাদের খোঁজেন। বৃহস্পতিবার বিকালে ভবনের ছাদ থেকে এক এক করে লাফিয়ে শ্রমিকরা মাটিতে পড়েন। এ ঘটনায় অনেকের হাত-পা ভেঙ্গে গেছে। মাথায়, পিঠে মারাত্মক জখম হয়েছেন। স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নিখোঁজ রয়েছেন ৪৫ জন। তাদের ৩৩ জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হচ্ছে ভোলা জেলার মহিউদ্দিন, শামীম, রাকিব হোসেন, মো. হাসাইন, হাফেজ, রাকিব, নোমন মিয়া, নারায়ণগঞ্জের ফিরোজা বেগম, আমেনা, ফিরোজা খাতুন, রিমা, নাজমা বেগম, পাবনার মোহাম্মদ আলী, কিশোরগঞ্জের নাঈম, ফারজানা আক্তার, নাজমুল হাসান, তাসলিমা, সাহিদা, খাদিজা, সেলিনা, আকলিমা, শাহানা, মিনা খাতুন, ফাতেমা আক্তার, জামালপুরের জিহাদ রানা, চাঁদপুরের পারভেজ, রাজশাহীর মাহবুব, গাজীপুরের রিপন মিয়া,  নেত্রকোনার শান্তা মনি, নবীগঞ্জের উর্মিতা বেগম, খালিয়াঝুড়ির হিমা, রংপুরের স্বপন,  মৌলভীবাজারের কম্পা বর্মন। শ্রমিকদের খুজঁতে আসা স্বজনদের আর্ত্মনাতে আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে উঠে।

এখানে ৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। করোনার কারণে কারখানার কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। কারখানার ষ্টোরেজ, কার্টন ও ফুড সেকশন ছয় তলায়। সেখানে চার শতাধিক শ্রমিক কাজ করছিলেন। শতাধিক শ্রমিক দোতলায় ফুড প্যাকেজিংয়ে কাজ করেন। তৃতীয় তলার কার্টরন সেকশন থেকে লাগা আগুন মুহুর্তে দোতলার টোস্ট সেকশন, তৃতীয় তলার লাচ্ছি ও লিচু সেকশন, ৪ ও ৫ তলার স্টোর পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে।  লকাডাউনের কারণে কারখানা আংশিক চলমান ছিল। সে কারণে ঘটনার দিন কর্মরত ছিল তিন হাজার শ্রমিক। তাদের অধিকাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। তারা সবাই  নি¤œ আয়ের মানুষ। স্বজনরা জানিয়েছেন, এখানে কর্মরত শ্রমিকদের আয়ে চলে তাদের সংসার। অর্ধাহারে-অনাহারে মানবত জীবন যাপন করছিলেন পরিবারের সদস্যরা।

কারখানার পার্শবর্তী চায়ের দোকানদার আব্দুর রহমান বলেন, আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পরেই ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে লাফিয়ে শ্রমিকরা মাটিতে পড়তে থাকে। উৎসুক মানুষের ছিল অনেক ভিড়। শুক্রবার দুপুরে কারখানা থেকে একের পর এক লাশ বের করে নিয়ে আসে উদ্ধারকর্মীরা।

কারখানার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে কারখানার অধিকাংশ ইউনিট বন্ধ ছিলো। চালু ছিলো অল্প কিছু বিভাগ। ভবনের একাধিক ফ্লোর গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কলাপসিবল গেইটে কে কেনইবা তালা লাগিয়েছেন তিনি তা বলতে পারেননি

নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী বলেন, নিহতদের দেহাবশেষ ডিএনএ পরীক্ষা করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ইতিমধ্যেই ময়নাতদন্তের ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য দেহাবশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনের কলাপসিবল গেট তালাবদ্ধ থাকায় উদ্ধার কাজ ব্যহত হয়েছে। তালাবদ্ধ না থাকলে এত প্রাণহানীর ঘটনা ঘটতো না।

নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান হাবিব, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ্ নুসরাত জাহান ও রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএফএম সায়েদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।

উল্লেখ্য, ৯ই জুলাই শুক্রবার ভবনের চতুর্থ তলা থেকে ৪৯ জনের দেহাবশেষ উদ্ধার। এর আগে গত ৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার ৩ জনের মৃত্যু হয়।

add-content

আরও খবর

পঠিত