নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( হিন্দু র্ধম বার্তা ) : বেলুড় মঠের শারদীয় দুর্গাপূজার ঐতিহ্যগত তাৎপর্য হলো ১৯০১ সালে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারাই এই পূজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয় এবং পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীও এই পূজার সময় বেলুড় মঠে উপস্থিত ছিলেন স্বামীজীরই ইচ্ছানুসারে। শ্রীশ্রীমায়ের নামাই এই পূজার (সঙ্কল্প) করা হয় এবং আজও সেই ধারাই চলে আসছে। আসলে সন্ন্যাসিগণ (সঙ্কল্প) করে কোন পূজা বা বৈদিক ক্রিয়াকা- করার অধিকারী নয় বলেই আদর্শ গৃহস্থাশ্রমী শ্রীশ্রীমার (যদিও ত্যাগ-তপস্যায় তিান সন্ন্যাসীরও শিরোমণি) নামেই বেলুড় মঠের পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অথবা স্বামীজী যে কল্পনা করতেন শ্রীশ্রীমাকে ‘জ্যান্ত দুর্গারুপে’, প্রতি বছর মৃন্ময়ী মূর্তিতে কী সেই চিন্ময়ী মায়েরই অধিষ্ঠান হয় ?
চলতি নৌকার আরোহিগণ বেলুর মঠ দেখিয়াই নানারুপ ঠাট্রা তামাসা করিত এবং এমন কি, সময় সময় নিঙ্কলঙ্ক স্বমীজীর সমালোচনা করিতেও কুণ্ঠিত হইত না। শিষ্যের মুখে এসব কথা শুনে স্বামীজী একটুও উত্তেজিত হতেন না, বরঞ্চ শিষ্যকে বোঝাতেন-(দেশে কোন নূতন ভাব প্রচার হওয়ার কালে তাহার বিরুদ্ধে প্রাচীনপন্থাবলম্বিগণের অভ্যুত্থান প্রকৃতির নিয়ম। জগতে ধর্মসংস্থাপক মাত্রকেই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। স্বমীজী কিন্তু সব সময়েই বলতেন-আমি শাস্ত্রমর্যাদা নষ্ট করতে আসি নি- পূর্ণ করতে এসেছি।
স্বামীজী যখন বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা করার বিষয় চিস্তা করছিলেন, সেই সময় তাঁর জনৈক সন্ন্যাসী ভ্রাতার একটি অলেীকিক স্বপ্ন- দর্শনও হয়েছেল। তিনি দেখেন যে, সাক্ষাৎ মা দশভূজা দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে গঙ্গার ওপর দিয়ে বেলুড় মঠের দিকে আসছেন। শুরুভ্রতার মুখে এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনে স্বামীজী আরো উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন, বলেছিলেন,যেরূপে হোক, এবার মঠে পুজো করতেই হবে। তখন শারদীয় পূজার আর মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি। সেই দিনই স্বামীজীর নির্দেশে একজন সন্ন্যাসী গেলেন কলকাতার কুমোরটুলীতে প্রতিমার বায়না করতে, আর একজন গেলেন বাগবাজারে শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে বেলুড় মঠে দুর্গা পূজার অনুমতি আনতে। সেীভাগ্য ক্রমে বায়না করতে দেরি হওয়া সত্বেও কুমোরটুলীতে একটি মৃন্ময়ী প্রতিমাও পাওয়া গেল, এবং বাগবাজারে চিন্ময়ী মায়ের অনুমতি মিলল। এতে স্বমীজীর আনন্দের সীমা নেই।
এরপর বেলুড় মঠের সেই প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা মহাসমারোহেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যথাসময়ে প্রতিমা এসেছিল কুমোরটুলি থেকে। স্বামী ব্রক্ষানন্দজীর ওপর ভার পড়েছিল পূজার সব উপরণ সংগ্রহের। পূজার আসনে বসেছিলেন কৃষ্ণলাল নামে জনৈক নবীন ব্রক্ষচারী। তন্ত্রধারক হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণানন্দজীর পিতৃদেব ঈশ্বর চন্দ্র চক্রবর্তী।
৩১শে আশ্বিন (১৭ই অক্টোবর), বৃহস্পতিবার মঠের সাধু ব্রক্ষচারী শ্রীশ্রীদুর্গাপ্রতিমা নেীকায় করিয়া মঠের ঘাটে তুলিলেন – ধীরে ধীরে যতœসহকারে ঠাকুরের ঘরের নিচের দালনে প্রতিমা রাখা হইল। কিছুক্ষণ পরে প্রবল বৃষ্টি- আকাশ যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল। মঠের জমিতে উত্তর দিকে যেখানে শ্রীরামকষ্ণের জন্ম-মহোৎসবে এখন বৃহৎ মশুপে পরিণত হয় – সেইখানে সেবার শ্রীশ্রীদুর্গাপ্রতিমার প্রকা- ম-প নির্মিত হইয়াছিল। ঝড় হইলেও যাহাতে কোন প্রতিবন্ধক না হয়, সেইরুপ সাবধানতার সঙ্গে ম-পটি তৈয়ার করা হয়েছিল।
শ্রীশ্রীমায়ের নামে সঙ্কল্প হইয়াছিল। তাঁহার অনভিপ্রেত বলিয়া পূজায় পশুবলিদান হয় নাই।
স্বামীজী মহাষ্টমীর দিন সহসা অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। শ্রীশ্রীমায়ের কথায় (প্রথম ভাগ) আছে- শ্রীমা বলিতেছেন, পূজার দিন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। ছেলেরা সবাই খাটছে। নরেন এসে বলে কি, মা, আমার জ্বর করে দাও। ওমা বলতে না বলতে খানিক বাদে হাড় কেঁপে জ্বর এলো। আমি বলি, ওমা একি হলো, এখন কি হবে? নরেন বললে, কোন চিন্তা নেই মা। আমি সেধে জ্বর নিলুম এই জন্যে যে, ছেলেগুলো প্রাণপণ দিয়ে খাটছে, তবু কোথাও কি ত্রুটি হবে, আমি রেগে যাব, বকবো। তখন ওদের কষ্ট হবে, আমারও কষ্ট হবে। তাই ভাবলুম – কাজ কি, থাকি কিছুক্ষণ জ্বরে পড়ে।
৫ই কার্তিক মঙ্গলবার বিজয় দশমী। অপরাহ্নে দলে দলে লোক মঠে প্রতিমা-বিসর্জন দেখিতে আসিল। গঙ্গাতীরের ঘাটটি লোকে লোকারণ্য হইল-তখন ঢাক, ঢোল, রসুনচেীকী এবং সঙ্গে সঙ্গে বাদ্য-যন্ত্র বাজিয়া উঠিল। গঙ্গাবক্ষে প্রতিমা যখন নেীকায় তোলা হইতেছিল চারদিকে “মহামায়ী কি জয় – দুর্গামায়ী কি জয়, শত শত কণ্ঠে ধ্বনিত হইল। পরদিন শ্রীশ্রীমা বাগবাজারে চলিয়া আছিলেন। আজও বেলুড় মঠে দুর্গোৎসব সেই স্মৃতি জাগিয়া উঠে। এখনও শুদ্ধসত্ব ত্যাগী সাধু ব্রক্ষচারীদের অর্চণায় আনন্দময়ীর পূজায় যে আনন্দ ও অপূর্ব ভাব উদ্দীপিত হয়- তাহা অন্যত্র দুর্লভ।
লেখক: তারাপদ আচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ।