নারায়ণগঞ্জে রাজাকার পুত্রের ডোন্ট কেয়ার !

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( বিশেষ প্রতিবেদক ) : বিভিন্নসময়ই নারায়ণগঞ্জে রাাজাকার ও রাজাকার পুত্র নিয়ে নানা কথা উঠে থাকে। কমবেশ তাদের কর্মকান্ড ও প্রভাব বিস্তার নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এমনকি নারায়ণগঞ্জ-৫ সদর ও বন্দর আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম ওসমানও এ বিষয়ে বেশ সোচ্চার। তবে সবকিছু অদৃশ্য কারণে ডোন্ট কেয়ার দেখালেন বন্দরে সুপরিচিত রাজাকার পুত্র সেলিম রেজা।

এই তো গত ৮মার্চ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম ওসমান বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতী-নাতনিরা দেখে রাখবে। তবে ভবিষ্যতে মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করে যেন কোন রাজাকার আলবদরদের গাড়িতে পতাকা না উড়তে পারে তার জন্য সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তবে এমন বক্তব্যের পর তিনি নিজেই অসর্তকভাবে উপস্থিত হলেন একজন রাজাকার পুত্রের অনুষ্ঠানে! যা দেখার পর বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও সাধারণ মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, একজন রাজাকার পুত্রের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহন আসলেই খুব দু:খজনক। এ অনুষ্ঠান বর্জন করাই ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব। আবার কেউ কেউ বর্জনও করেছেন। জানিয়েছেন নিন্দাও। উপস্থিত অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের বলতে শুনা গেছে, স্বাধীণতা বিরোধী চেতনায় বিশ^াসী রাজাকার এমএ ওহাবের পুত্র সেলিম রেজা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। অথচ অনেক মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। তা না হলে এদের সাহস কিভাবে হয় মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী এমপি- মন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকার। তবে দু:খ হয় যারা বাংলাদেশকে স্বীকার করতে চায় নাই। তাদের বংশধরদের হাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কতটা নিরাপদ।

এরআগে এ বিষয়ে কথা হলে বন্দর উপজেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার কাজি নাসির বলেছিলেন, এম এ ওহাব কলাগাছিয়া এলাকার। উনি যে মুক্তিযোদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছেন এটা সকলেই জানেন। নতুন কিছু না। উনি একজন পাকিস্তানের দালাল ছিলেন। অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়েছি, তবে তিনি যাবেন না।

এম ওহাবের রাজাকারদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা নিশ্চিত করে সদর উপজেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এড. নুরুল হুদা জানিয়েছিলেন, হ্যাঁ উনি রাজাকার ছিলেন। এখানে কারা যাচ্ছেন আমি তো জানিনা। তবে রাজাকার পুত্রের অনুষ্ঠানে কোন মুক্তিযোদ্ধা যদি গিয়ে থাকে, ভুল করবে। আমি এর তীব্র নিন্দা প্রকাশ করি।

তবে সকলের কথা উড়িয়ে দিয়ে অনুষ্ঠানের আগের দিন সেলিম রেজা বলেছিলেন, অনুষ্ঠান হবে। এটা আমাদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান। এম ওহাব সাহেব আমার বাবা, তাতে কি। মন্ত্রী-এমপি আসবে। আমি আমার মত চলছি কোন সমস্যা নাই। আই ডোন্ট কেয়ার। আর অবশেষে সেটাই হলো। অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে, যা গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এতে মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন অনেকেই উপস্থিতও ছিলেন।

রাজাকার পুত্রের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির বিষয়ে কথা হলে সাবেক নারায়ণগঞ্জ জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সামিউল্লাহ মিলন বলেন, এই অনুষ্ঠানের ব্যপারে আমরা কেউ অবগত না। তবে রাজাকারের পুত্রের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়া কোনভাবেই ঠিক হয়নি। আমি এ ব্যপারে নিন্দা জানাই। যেহেতু ডেপুটি কমান্ডাররাও নিন্দা জানিয়েছে। এটা নিয়ে আলোচনা হলে উনারই জানাবে। যেন এসব বিষয়ে সতর্ক থাকে। বিষয়টা খুবই দু:খ জনক।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিন সবুজ ক্ষোভ ও হতাশার সুরে বলেন, এটা কখনোই কাম্য না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যখন রাজাকারদের দেখি তখন হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। তাদরে এসব বর্জন করা উচিৎ। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে এতা কথা বলা হয়। কিন্তু বন্দর উপজেলায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে রাজাকার পুত্র পরিচালনা করে তা খুবই দু:খ জনক। আরো দু:খজনক মুক্তিযোদ্ধারা তা বয়কট না করে সেখানে চলে আসে। এতে করে আগামী প্রজন্ম কি শিখবে। উনারাই যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, তাই প্রত্যাশা করবো আগামীতে যেন এর পূণরাবৃত্তি না হয়।

প্রসঙ্গত, বন্দর এলাকার চিহ্নিত রাজাকার হিসেবেই পরিচিত এম ওহাব। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বন্দর থানা শান্তি বাহিনীর সভাপতি ছিলেন এম ওহাব। তৎসময় তার বাড়িতে তার সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে নির্যাতন করা হত। স্বাধীনতার পর তিনি এলাকার প্রভাব বিস্তার করে চলতেন। পরে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমানে পিতা না থাকলেও একই কায়দায় এলাকায় প্রভাব বিস্তাার করার পায়তারা করছেন তার বড় ছেলে সেলিম রেজা। আর এলাকায় নিজের অবস্থানের জানান দিতেই করা হয়েছে এতো বড় আয়োজেন। প্রায়শই সরকার দলীয় লোকদের সাথে করে তার রয়েছে ব্যপক সখ্যতা। আর তাই এই আয়োজনকে ঘিরে বন্দর উপজেলায় চলছে এখন ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা ঝড়।

উল্লেখ্য অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখক, ইতিহাসবিদ, গবেষক মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির নেতাদের তালিকা করেছেন। তাদের মধ্যে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ, শান্তিকমিটি ১৯৭১ ও রীতা ভৌমিকের লেখা মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ বইয়ে নারায়ণগঞ্জের রাজাকারদের তালিকা পাওয়া যায়। যারা সে সময় সাধারণ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। চালিয়েছে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম খন্ডে এবং রীতা ভৌমিক তার মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ বইতে ১৯৭১ এ নারায়ণগঞ্জে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজনৈতিক নেতা কর্মী সবাইকে এক কথায় যারাই মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেই সময়কার অনেক রাজাকার ও তাদের বংশধররা আজ রাজনীতিতে, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিলেন- এ এস এম সোলায়মান, এম. এ জাহের, সফর আলী ভুইয়া, আব্দুল বাসেত প্রমুখ। সেই বই থেকে বন্দর উপজেলায় তালিকা থেকে পাওয়া যায় অনেকর নাম যার মধ্যে রয়েছে এম এ ওহাবের নামও। এরমধ্যে উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কুড়িপাড়া গ্রামের (ধামগড় ইউনিয়ন) রফিক ছিলেন এলাকার চেয়ারম্যান। বর্তমানে তিনি ঠিকাদার ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এম. ওহাব। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কলাগাছিয়া গ্রামের (ইউনিয়ন কলাগাছিয়া) এম. ওহাব ছিলেন একজন পাট-সার ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। কাশেম। বন্দর থানার মাহমুদনগর গ্রামের (ইউনিয়ন সোনাকান্দা) কাশেম ছিলেন একজন চাল ব্যবসায়ী।

add-content

আরও খবর

পঠিত