নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : নারায়ণগঞ্জে খাদ্য সামগ্রী চেয়ে জাতীয় কল সেন্টার ৩৩৩ নম্বরে ফোন করার অপরাধে ফরিদ নামে অহসায় বৃদ্ধকে জরিমানা হিসেবে ১০০ গরীব মানুষকে সরকারি খাদ্য সহায়তার অনুরূপ প্যাকেট বিতরণ করায় সমালোচনার ঝড় বইছে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ নিয়ে নানা মন্তব্য করতে দেখা গেছে। জানা যায়, নিজের স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বিক্রি ও ধার–দেনা করে ৭৫ হাজার টাকার খাদ্য সামগ্রী কিনেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগবাড়ি শেষ মাথা এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। নিয়মিত এফএম রেডিও শোনেন তিনি। রেডিওতে সংবাদে তিনি জেনেছেন ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায়। সরকারি সহায়তা পেতে তিনি কল করেছিলেন ওই নম্বরে। এই একটি কলই কাল হলো তার। সহায়তা তো পাননি, উল্টো তিনি চারতলা ভবনের মালিক এমন তথ্যের ভিত্তিতেণ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছে তাকে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরার নির্দেশে তাকে ১০০ জনের মাঝে চাল, আলু, ডাল, লবন ইত্যাদি খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করতে হয়েছে। কিন্তু ১০০ জনকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার ছিল না। সদর ইউএনও আরিফা জহুরার এ রকম অমানবিক সিদ্ধান্তে দিশেহারা হয়ে পড়েন বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন। আর ১০০ জনের খাবার কেনার টাকা কই পাবেন আর না দিতে পারলে জেল হবে, এই লজ্জায় শুক্রবার রাতে দুইবার আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন তিনি।
এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে নিজের স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বিক্রি ও ধার–দেনা করে বিতরণের জন্য এসব খাদ্য সামগ্রী কিনেছেন। এমনকি স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর থেকেও ধার নিয়েছেন ১০ হাজার টাকা।
ফরিদ উদ্দিনের ছোট ভাই শাহীন ও আরেক ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিস বেগমও সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো না। চারতলায় টিনশেডের দুটো ঘরই তার সম্বল। অথচ তাকে চারতলা বাড়ির মালিক বলে জরিমানা করেছেন ইউএনও।
বিলকিস বলেন, ১০০ জনের খাবার কেনার টাকা কই পাবেন আর না দিতে পারলে জেল হবে, এই লজ্জায় শুক্রবার রাতে দুইবার আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন আমার ভাসুর। মেয়েটা অবিবাহিত তাই লোকলজ্জার ভয়ে গয়না বিক্রি, ধার দেনা করে ৭৫ হাজার টাকার খাদ্য সামগ্রী কিনেছেন।
জানা গেছে, ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদের ১৬ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে, স্নাতক পড়ুয়া মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে। এক সময়ে স্থানীয় এক হোসিয়ারি কারখানায় কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন। তিনবার ব্রেন স্ট্রোক করার পর ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ফরিদ এখন কাজ করতে পারেন না। ওই কারখানাতেই শ্রমিকদের উপর নজরদারি রাখা বাবদ মাসে ১০ হাজার টাকা পান তিনি। তাতে কষ্টে সৃষ্টে চলছিল তার সংসার। তবে করোনাকালীন সময়ে পড়েছেন মহাসংকটে। একরকম নিরুপায় হয়েই জাতীয় কলসেন্টারের ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চান ফরিদ।
ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আমি বাড়ির মালিক এটা সত্য কিন্তু এ চার তলা ভবনের দুই রুমের ফ্ল্যাটে আমি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করি। আর বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটে আমার আরো ৫ ভাই ও এক বোন বসবাস করে। এ বাড়িতে কোনো ভাড়াটিয়া নেই। আমি হোসিয়ারীতে কাজ করি। মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন দেয়। এ টাকা দিয়ে মেয়ের পড়ালেখা, ছেলেটা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাই তার ওষুধের টাকা, নিজের ওষুধ ও সংসার খরচ চলে না। খুব কষ্ট করে জীবন যাপন করছি। ৩৩৩ নাম্বারে ফোন দিলে খাবার সহায়তা দিবে। যার জন্য ৩৩৩ এর ফোন দেই। একদিন পর স্থানীয় কাশিপুর ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ও প্যানেল চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী ফোন দিয়ে বলেন আপনি বাড়ির মালিক আপনার জন্য এ সহায়তা না। আপনি কেন চাইতে গেলেন? আমি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ক্ষমা চাইবেন। এর দুই দিন পর ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করলে আমি ফোন দিয়েছি স্বীকার করি। মেম্বারের কথায় আমি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফোন দেয়ার জন্য ক্ষমা চাই। তখন তিনি ক্ষমা না করে ১০০ জনের মধ্যে খাবার বিতরণের জরিমানা করে। অন্যথায় ৩ মাসের জেল। সেজন্য আমি আজকে খাবার বিতরণ করি।
তিনি আরো বলেন, তার আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। কাজ করতে পারেন না। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্য মেয়ে টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগান। প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য নিয়মিত ওষুধ লাগে। তার নিজেরও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দুই চোখেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনবার স্ট্রোক করেছেন। কোনো রকমের সঞ্চয় নেই তার। নিজের ওষুধ কেনারও পয়সা নেই। ছয় ভাই ও এক বোন মিলে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে চারতলা ভবন করেছেন। চারতলায় উপড়ে টিন শেড দেওয়া দুটি ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ফরিদ। নিজে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন বলেই সরকারি সহায়তার জন্য ওই নম্বরে কল করেছিলেন বলে জানান এই বৃদ্ধ। সহায়তা চেয়ে আরও বিপদে পড়েছেন তিনি।
ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ এর স্ত্রী হিরন বেগম বলেন, স্বর্ণের দোকানে মেয়ের গলার চেইন বন্ধক দিয়ে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। আর আশে পাশের আত্মীয় স্বজন, পরিচিতদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এ খাবার বিতরণ করছি। এ বলে তিনি কান্না শুরু করেন।
তবে সদর ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, সরকার ৩৩৩ কল সেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দু:স্থ মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে তাদের সংকটের কথা জানালে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ফরিদ উদ্দিন নামে ওই ব্যক্তিও খাদ্য সহায়তা চেয়ে ওই নম্বরে কল করেন।
পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ব্যক্তি চারতলা ভবনের মালিক এবং যথেষ্ট স্বচ্ছল। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে ফরিদ উদ্দিনকে ১০০ গরীব মানুষকে সরকারি খাদ্য সহায়তার অনুরূপ প্যাকেট বিতরণ করার নির্দেশ দেন ইউএনও আরিফু জহুরা।
২২ই মে শনিবার খাদ্য সামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন ইউএনও আরিফা জহুরা, সদরের এসিল্যান্ড হাসান বিন আলী, কাশীপুর ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আইয়ুব আলীসহ স্থানীয় এলাকাবাসী। এ সময় বিতরণ করা প্রতি প্যাকেটে সরকারি সহায়তার মতো ৫ কেজি চাল, ১ কেজি করে আলু, ডাল, সয়াবিন তেল, লবন ও পেয়াজ ছিল।
এসব খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করার সময় ইউএনওর সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফরিদ উদ্দিন ও তার পরিবারের লোকজন। তারা জানান, ধার–দেনা করে তারা এই খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন। তাদের পারিবারিক অবস্থা অস্বচ্ছল ছিল বলেই ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। তারা চারতলা ভবনের মালিক না।
এদিকে ফরিদ উদ্দিনের বাড়ির পাশেই স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর বাড়ি। তিনি ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থার কথা জানতেন। যেদিন ইউএনও তাকে ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইয়ুব আলী।
তিনি কেন ইউএনওকে সঠিক তথ্য জানালেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ইউপি সদস্য দাবি করেন, তিনি ইউএনওকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। অল্প জরিমানা করারও অনুরোধ তিনি করেছিলেন। তবে ইউএনও তার কথায় পাত্তা দেননি বলে দাবি আইয়ুব আলীর।
খাদ্য সহায়তা চাওয়া ফরিদ উদ্দিন সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল ছিল কিনা এবং লঘু পাপে তিনি গুরুদন্ড পেলেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে এসব খোঁজখবর নেওয়া হয়। ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী তাকে ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক স্বচ্ছলতার তথ্যই দিয়েছিলেন।
এমনকি সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েও তিনি একই তথ্য পেয়েছেন বলেই ওই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে যেহেতু তার আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টি সামনে এসেছে সে বিষয়ে যাচাই–বাছাই করবেন বলেও জানান আরিফা জহুরা।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ওই ব্যক্তি তার স্বচ্ছলতার কথাই নাকি ইউএনওকে জানিয়েছিলেন। এখন যেহেতু নিজের অসহায়ত্বের বিষয়টি সামনে এনেছেন সে অনুযায়ী তিনি আবেদন করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে যে ধরনের সহযোগিতা করা যায় তা করা হবে।