নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( স্টাফ রিপোর্টার ) : বিভিন্ন সময়ই ভূূমিদস্যুতা, চাদাঁবাজী, নারী কেলেংকারী সহ নানা অভিযোগে সমালোচিত সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও কৃষকলীগ সভাপতি নাজিম উদ্দিন। বিতর্কিত নানা অপকর্মের কারণে হয়েছেন গণমাধ্যমে শিরোনামও। এছাড়াও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডস্থ সাইনবোর্ড ও ফতুল্লা ভূইগড় রূপায়ন টাউনেও রয়েছে তার ব্যপক অধিপত্য বিস্তার। ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ায় দখল আর নৈরাজ্যে গড়ে উঠা, বর্তমানে সে এখন মুর্তিমান আতংক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু সকল অপকের্মর পরেও অদৃশ্য শক্তির কারণে বার বার অপরাধ করেও পুলিশ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে সে অধরাই রয়ে যাচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় নানা ভয় ভীতি দেখিয়ে রূপায়ন টাউনের ৭৮৪ টি ফ্ল্যাটের প্রায় দুই হাজার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল নাজিম উদ্দিন। অভিযোগ উঠেছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল সহ নানা অযুহাতে অনেক দিন ধরেই চাদাঁ দাবী করে আসছিল শামীম ওসমানের আস্থাভাজন নেতা নাজিম উদ্দিন। আর সে চাদাঁ দিতে অস্বিকার করায় নাজিম উদ্দিনের নির্দেশে তার বাহিনীর মারধরে আহত হতে হয়েছে ২১ ব্যচের বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক, সাংবাদিক সহ কয়েকজনকে। এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুইটি মামালা দায়ের করেছে ভুক্তভোগীরা।
এদিকে রূপায়ন টাউনে বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ থাকলেও নাজিম বাহিনী অবলীলায় সেখানে প্রবেশ করছে আর আড্ডা জমাচ্ছেন এবং করেন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। এ নিয়ে প্রতিবাদ করে বিভিন্ন সময় ফ্ল্যাটের অনেক বাসিন্দাই নিগৃহিত হয়েছেন এই সন্ত্রাসী বাহিনীর দ্বারা। শুধু হামলা নয়, তারা বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটে লুটপাটও চালিয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, রূপায়নের পক্ষ হয়ে তিনি অসংখ্য নিরীহ মানুষের জমি জবর দখল, নামমাত্রা মূল্যে আমমোক্তারনামা দলিলে লিখেও নিয়েছেন। ভূইগড়ের অসংখ্য পরিবারকে তিনি পথে বসিয়েছেন। এমনকি নিজেদের জমির প্রাপ্য অধিকার রক্ষায় প্রতিবাদ করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান রাসেল নামে এক যুবক নির্মম ভাবে খুন হয়েছেন নাজিম উদ্দিনের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে।
২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে নাজিম উদ্দিনের সন্ত্রাসী বাহিনী রাসেলকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে নির্মম ভাবে খুন করে। এ ঘটনায় রূপায়ন টাউন-নারায়ণগঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিয়ার আলী মজুমদারকে প্রধান এবং নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও রূপায়ন টাউন-নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক নাজিম উদ্দিন আহমেদকে দ্বিতীয় আসামি করে ১৩ জনের নামে মামলা দায়ের করেন নিহত রাসেলের বোন ফৌজিয়া খাতুন।
রাসেলদের সাথে ৫২ শতাংশ জমি নাজিম উদ্দিন দলীয় প্রভাব বিস্তার করে জোরজবরদখ করে নেয়। যা পরবর্তীতে রূপায়ন টাউনের কাছে নামমাত্রা মূল্যে বায়না করতে বাধ্য করা হয় রাসেলদের পরিবারকে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয় রাসেল। এতেই দমে যায়নি নাজিম উদ্দিনসহ তার বাহিনী। উল্টো ভুক্তভোগি এই পরিবারটিকে ১৭টি মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর হয়রানি করিয়েছে এই ভাইস চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় রূপায়ন কর্তৃপক্ষ। সূত্রের মতে, এখনও পর্যন্ত সে জমির মূল্য পরিশোধ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
শুধু রাসেলদের পরিবারই নয়। ভূঁইগড় মৌজায় সিএস খতিয়ান-৪১, এসএ খতিয়ান-৫৫, আরএস খতিয়ান-৭০২, সিএস, এসএ দাগ-১২২৭ এবং আরএস দাগ-৩৯২২ এর ৪৪ শতাংশ জমির রেকর্ডসূত্রে মালিক মনর উদ্দিন। নাজিম উদ্দিনের করালগ্রাসে জাল দলিল ও ভুয়া মালিক সৃষ্টি করে মনর উদ্দিনের ওয়ারিশদের ৪৪ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে রূপায়ন টাউন।
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন এবং তার ভাইদের ৩৯১১ দাগের ৩০ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে নাজিম উদ্দিনের সহায়তায় ওই একই প্রতিষ্ঠান। ১২২৭-এর রেকর্ডভুক্ত জমির মালিক সুনর উদ্দিন সর্দার। ওয়ারিশ সূত্রে এ জমির মালিক মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন সর্দার গং। এ দাগে মোট জমির পরিমাণ ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২ শতাংশের মালিক মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন সর্দার। তাদের জমিও বেহাত হয়েছে নাজিম উদ্দিনের ভূমিদস্যুতায়। ভুঁইগড় মৌজার সিএস ও এসএ-১২২৭ ও ১২২৮ নম্বর দাগের ৭২ শতাংশ জমির ক্রয়সূত্রে মালিক বক্তাবলীর আবুল হোসেন। তার জমিটিও দখলে নিয়েছে নাজিম উদ্দিন বাহিনী রূপায়নের পক্ষ হয়ে। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সে জমি নামমাত্রা মূল্যে আবুল হোসেন বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, বহুল বিতর্কীত এই ব্যক্তি পরিবহন সেক্টর থেকে শুরু করে হাটসহ নানা ধরণের কার্যক্রমে ক্ষমতাসিন দলের প্রভাব বিস্তার করেই নিজের কতৃত্ব ধরে রেখেছেন। একটি প্রভাবশালী পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ার কারণে পুলিশ প্রশাসন বরাবরই এই ভাইস চেয়ারম্যানে বিরুদ্ধে কখনোই হার্ডলাইনে যায়নি। আর এই আস্কারাতেই দিনে দিনে তিনি অধিক বেপোরয়া হয়ে ওঠেছেন।
তবে, সর্বত্র প্রভাব বিস্তারের জন্য তার বিশাল একটি বাহিনীও রয়েছে। এই বাহিনীই মূলত চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস আর রাহাজানির মতো কর্মকান্ড সংঘটিত করে থাকেন। এই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে তারই ছোট ভাই শরীফ (৩৮)। আর এদের নেপথ্যে থেকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকেন নাজিম উদ্দিন নিজেই। সর্বশেষ (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে ‘ছোট ভাই’ শরীফসহ এই বাহিনীর তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। অন্য দুজন হলেন, রাজ্জাক মোল্লা ও রাসেল সাউদ। চাঁদার দাবিতে একটি গাড়ি চালককে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
আরো অভিযোগ রয়েছে, সাইনবোর্ড এলাকায় পরিবহন সেক্টরে রামরাজত্ব চলে এই নাজিম উদ্দিন বাহিনীর। প্রতিটি পরিবহন থেকেই নিয়মিত হারে চাঁদা উত্তোলন করে তার লোকজন। লেগুনা, টেম্পু, ইজিবাইকও তাদের কাছ থেকে বাদ যায় না। এক কথায়, সাইনবোর্ড এলাকায় নাজিম উদ্দিনের কথাই শেষ কথা। শুধু তাই নয়, সাইনবোর্ড এলাকায় সরকারি জমি ভরাট করে এই নাজিম উদ্দিন অবৈধ ভাবে একটি স্ট্যান্ডও গড়েছেন। এখানে অনাবিল পরিবহনের গাড়ি রাখা হয়। এই বাবদ তিনি প্রতিমাসে দেড় লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। যা সোমবার এই বাহিনীর গুন্ডাদের হাতে বেধম প্রহারের স্বীকার বাস চালক বাবুর দায়ের করা মামলাতেই উলে¬খ আছে।
এছাড়াও এক রমণীকে নিয়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় খোদ নাজিম উদ্দিনকে নিয়েই তোলপাড় শুরু হয়েছিলো গেল বছরের শেষের দিকে। এ ঘটনায় নাজিম উদ্দিনের তৃতীয় স্ত্রী সুমাইয়া আলম নামের ওই রমণী মামলাও করেছিলেন। প্রথম দু’টি বিয়ে গোপন করে এই নারীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন বলে ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়।
সুমাইয়া আলম জানিয়েছিলন, গেল বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে পিস্তল ঠেকিয়ে ২১ মাস বয়সী সস্তান নাজিলা আক্তার মিতুসহ তাকে বাসা থেকে বের করে দেন নাজিম উদ্দিন। তিনি তার সন্তান নিয়ে ডেমরা এলাকার সেতুবন্ধন টাওয়ারে মায়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন।
ওই ঘটনার তিনদিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর নাজিম উদ্দিন তার দুই স্ত্রী মনোয়ার ও শামীম আরাসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী নিয়ে সুমাইয়ার পরিবারের লোকজনদের মারধরসহ অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২১ মাসের শিশু সন্তান নাজিলা আক্তার মিতুকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য সুমাইয়া আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে ফতুল¬া থানা পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে সুমাইয়া আলমের কাছে হমÍান্তর করেন।
সুমাইয়া আলম জানান, প্রথম দুই স্ত্রীর বিষয়টি গোপন রেখে দুই বছর আগে তাকে বিয়ে করেছিলেন নাজিম উদ্দিন। এরপর তাকে ভূইগড়ের নিজ বাড়িতে তুলেছিলেন তিনি। আর প্রতি রাতেই মদ্যপ অবস্থায় তাকে মারধর করতেন নাজিম উদ্দিন। এর মধ্যে নাজিম উদ্দিন ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে তার কাছে। পরে আগের দুই বিয়ের খবরও জানাজানি হয়ে যায়। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নির্যাতন থেকেও রেহাই পাননি তিনি।
এর আগে তিনি আলোচনায় আসেন তার পালিত কন্যার পরকীয়া এবং ভেগে যাওয়ার ঘটনায়। ওই ঘটনায়ও তিনি তার বাহিনীকে ব্যবহার করেছিলেন। যা আদালত পাড়ায় প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটে। ঘটনা সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিনের পালিত মেয়ে ও ভূইগড় রূপায়ন টাউনে বসবাসকারী উইসুফ মিয়ার স্ত্রী দু’ সন্তানের জননী নাজিরা আক্তার মিতু সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গোদনাইল এলাকার মৃত শামসুল হকের ছেলে এক সন্তানের জনক আবুল হোসেন সজিবের সাথে পরকীয়ার টানে গেল বছরের ১৮ এপ্রিল ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এছাড়াও গেল বছরের মাঝামাঝি সময়ে পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নাজিম উদ্দিন বাহিনীর সাথে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জনের মতো আহত হয়েছিলো। পুলিশ ওই ঘটনায় নাজিম উদ্দিনের দুই শিষ্য আলমগীর ও সোবহানকে গ্রেফতারও করেছিলো।
নারায়ণগঞ্জ জেলা শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আলী হোসেন জানিয়েছিলেন, সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন আমাদের জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের তিন নম্বর উপদেষ্টা হয়ে সাইনবোর্ডের অফিসে বসতেন। একপর্যায়ে তিনি দলবল নিয়ে লেগুনা, ইজিবাইক, দূরপাল¬ার যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী যানবাহন থেকে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি করে হাতিয়ে নেন। কিন্তু সংগঠনের কোনো কল্যাণ ফান্ড তৈরি করেননি। এ বিষয়ে একাধিকবার তাগিদ দিয়েও নাজিম উদ্দিনের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি। এছাড়া লিংক রোড দখল করে শতাধিক দোকান ঘর তৈরি করে প্রত্যেকটি দোকান থেকে অগ্রিম ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। সেই টাকার একটিও আমাদের শ্রমিক সংগঠনে দেননি।
এসব ব্যাপারে জানতে সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও কৃষকলীগ সভাপতি নাজিম উদ্দিন এর মুঠোফোনে ব্যবহৃত নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সংযোগ স্থাপন করেননি। তাই মন্তব্য পাওয়া যায়নি।