অভিযান আরো জোরদার হচ্ছে : এসপি রাসেল
নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সৈয়দ সিফাত লিংকন ) : নগরীর বোয়ালিয়া খাল সড়কে এবার কিশোর গ্যাংয়ের তান্ডবে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ১৭ বছর বয়সী অপর কিশোর নয়ন সিকদারের। পেশায় সে একজন পোশাক শিল্প কারখানার শ্রমিক ছিল। এরআগেও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া, সাংবাদিককে হত্যা চেষ্টাসহ চুরি-ছিনতাইয়ের মত নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এ স্থানটিতে। বহিরাগত সন্ত্রাসী বাহিনীদের অত্যাচার এবং একের পর এক অপরাধের কারণে সদর ও ফতুল্লা অন্তর্ভুক্ত দুই থানার সিমানাবর্তী বোয়ালিয়া খাল সড়কের আশপাশের এলাকাও এখন অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি কয়েক বছরের ধারাবাহিকতা ও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুরো জেলায় মারাত্মক ব্যাধির মত আকার ধারণ করেছে এই কিশোর অপরাধ। অনেকেই অতিষ্ট হয়ে বলেছেন, এ যেন পুরো জেলায় কিশোর গ্যাংয়ের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সচেতন মহল বলছেন, বর্তমান জেলার পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল গেল বছরের আগস্টে যোগদান হওয়ার পরে সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের সাথে মতবিনিময় করেছিলেন। ওইসময় তিনি গুরুত্ব দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন কিশোর গ্যাং, মাদক, সন্ত্রাস, যানজট নির্মুলে তিনি যথাযাথ ভূমিকা রাখবেন। এরই মধ্যে যানজট নিয়ে বেশ কয়েকবার সফলতা দেখিযেছেন। মাদক সন্ত্রাসের ব্যপারেও সোচ্চার ভূমিকা রয়েছে। কিশোর গ্যাং র্নিমুলে চিহ্নিতদের গ্রেপ্তার করতেও সক্ষম হয়েছেন। তবে যোগদানের ১১ মাসে পর্দাপন করেও পুলিশ সুপারের চেষ্টাকে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব ও জনগনের অসচেতনতার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ মূল থেকে উৎপাটনের ক্ষেত্রে তেমন বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয় নি।
প্রসঙ্গত, কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়ে যোগদানের পরে সুশীল সামজের সাথে মতবিনিময়ে এসপি বলেছিলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ে অলরেডি কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে আমি সাংবাদিক ভাইদের সাথে বসেছিলাম, আমাদের বিট পুলিশিংয়ের সময় প্রত্যেকটা বিটে বিটে আমি কিশোর গ্যাং এর সংখ্যা জানবো। কোন এলাকায় কিশোর গ্যাং আছে, এই পরিসংখ্যান টা আগে আমার জানা দরকার। ইতিমধ্যেই আমি আমার বিটের অফিসারদের কাছে এ পরিসংখ্যানটা আমি চেয়েছি। এটা হাতে পেলেই ইনস্ট্যান্ট অপারেশনের নামবো। এটা আমি আপনাদের মাধ্যমে সারা নারায়ণগঞ্জবাসীকে জানাতে চাই, তখন যদি কেউ তদবির করেন। আর যদি আমি দেখি সে প্রকৃত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং অপরাধী। তা হলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে, গেল শুক্রবার প্রকাশ্যে বড় ছুরি-দাঁ নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় নয়ন সিকদারকে ছুরিকাঘাতে গলা কেটে হত্যাকান্ডের পর স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাত হলেই জনসাধারণের চলাচল কমতে থাকায় বোয়ালিয়া খালের সড়কটি নিস্তব্দ হয়ে যায়। একই সাথে এ সড়ক ঘেঁষা বেশ কয়েকটি এলাকায় আসা-যাওয়ার জন্য শাখা সড়ক ও অলি-গলি রয়েছে। যে কারণে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বহিরাগত অপারাধীরা নানা অপকর্ম করে পালিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও এ সড়কে অবস্থিত বেশ কয়েকটি দোকানে চুরিও সংঘটিত হয়েছে। বেশ কয়েকবার ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছিল। কেউ কেউ জরুরী সেবা ৯৯৯-এ কল দিয়ে সেবা চেয়েছে। আবার কেউ সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগও জানিয়েছেন। কখনো ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেছে কখনো অন্য থানার আওতাভুক্ত এমনটা নির্ধারনেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। এভাবেই প্রতিকার না পাওয়ায় অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলেও দাবী অসংখ্য ভুক্তভোগীদের।
এমনকি এরআগেও বোয়ালিয়া খাল সড়কে ২০ থেকে ২৫ জনের একটি কিশোর গ্যাংয়ের বাহিনী দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে হামলা করতে দেখা গেছে। যে ভাইরাল ভিডিও দিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। পরবর্তিতে মামলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই রেশ না কাটতেই বোয়ালিয়া খাল সড়কের পাশ্ববর্তি এলাকায় সিটি করপোরেশনের ১৪নং ওয়ার্ডে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সড়কে ফেলে হত্য করা হয়েছিল স্থানীয় সুব্রত মন্ডল জয় নামে এক যুবককে। তাছাড়া বোয়ালিয়া খাল সড়কের পাশেই স্থানীয় এক সাংবাদিককে হত্যা চেষ্টা করেছিল মাদক কারবারীরা। তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় গুরুতর আহত হওয়ায় সাংবাদিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় ফতুল্লা থানায় ভুক্তভোগীর পিতা অভিযোগও দায়ের করেছিল। তবে প্রকৃত আসামীরা ধরা ছোয়ার বাহিরেই রয়ে গেছে। বাদ যায়নি সাংবাদিক পুত্র। জামতলা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়েছিল। পরে ওই সাংবাদিক পুত্রকে খানপুর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।
অন্যদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা নিহতের পরিবার। কেন, কি কারণে মারলো? দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবীতে হতবাক নিহত নয়নের বাবা জালাল সিকদার। নিহতের বাবা জানান, তার দুই মেয়ে রয়েছে এবং একমাত্র ছেলে নয়ন সিকদার। দুষ্টুমী করতে বিধায় সবসময়ই শাসনে রাখতো। কিন্তু এমন কি অপরাধ করেছিল, যে এভাবে মেরে ফেলল।
জানা গেছে, শুক্রবার রাত ৮টায় নয়ন ওই সড়কে তার বন্ধুদের নিয়ে মার্বেল খেলছিল। ওইসময় কিশোর গ্যাংয়ের একটি বাহিনী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় তাদের ছুরিকাঘাতে নয়নের গলা ও হাতসহ বিভিন্নস্থানে মারাতœকভাবে জখম হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নয়নকে মৃত ঘোষণা করেন। এরইমধ্যে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ছয় জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এছাড়াও ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রকৃত আসামীদের শনাক্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে ফতুল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নুরে আজম মিয়া জানায়, নয়ন হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার মা বাদি হয়ে মামলা করেছেন। ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছি। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে পুর্ব শত্রুতার জের ধরেই এই হত্যাকান্ড হয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ছিলো। আমাদের অভিযান চলছে, তদন্ত করছি। প্রকৃত যারা দোষী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
বোদ্ধা মহল বলছেন, সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় সঘর্ষে জড়িয়ে খুনের মত অপরাধ করে ফেলছে। আর এসবে সংশ্লিষ্ট পাওয়া যায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছায়া, বড় ভাই-ছোট ভাই দ্বন্দ্ব, মাদক কারবারী সিন্ডিকেট, আধিপত্য বিস্তারসসহ অনৈতিক কাজে কিশোরদের ব্যবহার এবং অন্যায় কাজে শেল্টার দেয়া। তাছাড়া স্থানীয় মুরুব্বী ও কমিউনিটি পুলিশে দায়িত্ব থাকা কর্তাদের দায়িত্বহীনতাকেও দায়ী করছেন অনেকেই। এতে রয়েছে অভিভাবকদের পুরোপুরি অসচেতনতা। স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপসালয়ে অপরাধের শাস্তি ও মনুষত্ববোধ, শান্তির পথ পদর্শক বিষয়ক আলোচনা না থাকাকেও দায়ী করেছেন সচেতন মহল।
কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল পিপিএম বলেছেন, আমরা কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি। প্রোঅ্যাকটিভ পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অভিযান করছি। নয়ন হত্যাকান্ডের ঘটনায় আসামীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সামনে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় যেন কিশোর গ্যাং বৃদ্ধি না পায় এজন্য অভিযান আরো জোরদার করা হচ্ছে। আমরা তালিকাও করেছি, সে অনুযায়ী গ্রেপ্তার করেছি। কার্যক্রম চলছে। নতুন করে যারা কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তবে অভিভাবক ও স্থানীয় মুরুব্বীদেরকেও দায়িত্ব নিতে হবে, সচেতন হতে হবে। সন্তান কোথায় যায় কি করে খোঁজ নিতে হবে। শুধু পুলিশ নয় সকলকে কিশোর গ্যাং নির্মূলে এগিয়ে আসতে হবে।