নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( প্রেস বিজ্ঞাপ্ত ) : ২০০১ সালের ৫জুন যে মানুষটি নিখোঁজ হলেন তিনি আজও ফিরে আসেননি। হয়তো আর কোন দিন তিনি ফিরেও আসবেনা। তারপরও পথ চেয়ে থাকা। প্রতিক্ষা করা। এই বুঝি স্বভাবসুলভ হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলছেন কেমন আছেন কমরেড।
স্বাধীনতার পরবর্তি জোতদারদের বিরুদ্ধে মরণপন লড়াইয়ের অবতির্ন হয়ে আপন ছোট ভাইসহ বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধার জীবনের বিনিময়ে খাস জমি উদ্ধার করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে দেয়ার ইতিহাস সৃষ্টিকারী কিংবদন্তি এ মহা নায়ক কমরেড রফিক খান। এলাকাবাসী তাকে আদর করে ডাকতেন লাল খান বলে।
অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া, শিশুকালেই পিতৃহারা হয়ে মামার বাড়ীতে বেরে উঠা মানুষটি এলাকার মক্তবে দু-এক ক্লাশ পড়াশোনার পুজিঁ নিয়েই জীবন সংগ্রাম শুরু করে ছিলেন। প্রচলিত সুখ স্বাচ্ছন্দ ছিল তার কাছে আকাশের পূর্নিমা চাঁদে মতন। একরকম শিশুকালেই রফিককে পেটের দায়ে চলে যেতে হয় খুলনাতে। দাদ্রিতার কারণে নিরানন্দ শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পন করেই তিনি বুঝতে শুরু করেন নিপিড়িত নির্যাতিত অসহায় বঞ্চিত মানুষে জন্য কিছু করতে পারাই জীবনের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত। খুলনার জুট মিলে লোড-আনলোড শ্রমিক হিসাবে কাজ করার সময় এই আজন্ম প্রতিবাদী মানুষটি প্রতিবাদহীন চুপচাপ সাধারণ শ্রমিকের মতো জীবন যাপন করতে পারলেন না।
রফিক খান দেখলেন মিল মালিক, কন্ট্রাকটর আর স্থানীয় ফরিয়া ও মাস্তানদের সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকগণ। তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। পন করলেন শ্রমিকদের সংগঠিত করবেন, প্রতিবাদ করবেন। তিনি একাই শুরু করে দিলেন শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ নামক একটি বাম ধারার শ্রমিক সংগঠনের সাথে তার পরিচয় হয়ে উঠে। তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমেই মার্কসবাদে দিক্ষিত হন। শুরু করেন শ্রমিকদের পুরোদমে সংগঠিত করার কাজ। তারই নেতৃত্বে খুলনা জুট প্রেস এন্ড বেইলিং-এর প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিককে সংগঠিত করে বহু রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে শ্রমিকদের তৎকালীন আশু দাবীদাওয়া আদায় করেন। মালিক, কন্ট্রাকটর আর স্থানীয় ফরিয়া ও মাস্তানরা রফিক খানসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যার্থ হয়, আন্দোলন মেছাকার করে দেয়ার পরিকল্পনা করেও বারবার মালিক পক্ষের সকল ষড়যন্ত্রই পরাস্ত হয়। হাজার হাজার শ্রমিকের আন্দোলন সংগ্রামের সকল অর্জন রফিক খান শ্রমিকদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার কিছুদিন পরে ১৯৭২ সালে তার নিজ এলাকা মাদারীপুরে ফিরে আসেন।
জন্মস্থানে এসে রফিক খান লক্ষ্য করলেন অত্যচারী জোতদারগণ সাধারণ ভূমিহীন কৃষক ক্ষেতমজুরদের বঞ্চিত করে হাজার হাজার বিঘা সম্পত্তি নিজেদের দখলে নিয়ে অসহায় দরিদ্র অসহায় মানুষদের উপর সীমাহীন শোষন নিপিড়ণ করছেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার উপর নেমে আসছে নরক যন্ত্রনা। যেন বোতলে আটকে পরা কিটের মতো প্রতি মূহুর্তে মৃত্যুর ছটফটানি। তিনি এই স্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালেন। সর্বশক্তি দিয়ে ভূমিহীন কৃষক ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করে এক মরণপন লড়াইয়ে অবতির্ন হলেন। রফিক খানের সেদিনকার সে লড়াই অসহায় বঞ্চিত ভূমিহীন কৃষকদের মুখে হাসি ফোঁটায়। ভূমিহীন কৃষকরাই সেদিন বিজয়ী হন। বিজয়ী হন রফিক খান।
ব্রিটিশ আমলে পৌরসভার নয়ারচর এলাকায় বিপুল পরিমাণ স¤পত্তির উপর ইংল্যান্ডের আরসিন কো¤পানির বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ডাকবাংলো ও বড় বড় গুদাম ছিল। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীনতার পর আরসিন কোম্পানি তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি আদমজী কো¤পানিকে দিয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই সম্পত্তি মালিক হয় পাকিস্তানের আহমেদ বাওয়ানী কোম্পানি। আহমেদ বাওয়ানী কো¤পানি মালিকানা হস্তান্তর করে লতিফ বাওয়ানীর কাছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ওই সম্পত্তি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় পার্শবর্তী গ্রামের প্রভাবশালীরা ওই সম্পত্তি ধীরে ধীরে দখল করার পাঁয়তারা শুরু করে। রফিক খান দখলদারদের কাছ থেকে এই খাস সম্পত্তি উদ্ধার করে নিজের জন্য কিছুই রাখলেন না, পুরোটাই বিলিয়ে দিলেন ভূমিহীন কৃষক ক্ষেতমজুরদের মাঝে।
১৯৭৬ সালে তিনি এবার নিজ জিবিকার সন্ধানে চলে এলেন আরেক শিল্প নগরী নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জে এসে রফিক খান বহু কাঠখড় পুঁড়িয়ে এক পর্যায়ে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কমরেড শফিউদ্দিন আহমেদের সহযোগীতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার শাখায় চাকুরীর সুযোগ করে নেন। চাকুরীর পাশাপাশি তিনি পার্টিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। নারায়ণগঞ্জের শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার মধ্যো দিয়ে তিনি খুব দ্রুতই নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের কাছে হয়ে উঠেন অত্যন্ত পরিচিত মুখ। নারায়ণগঞ্জের শ্রমজীবী মানুষে আন্দোলন সংগ্রামের অকৃতিম বন্ধু।
আজ ২০০১ সালের ৫জুন রফিক খান হত্যার ১৮ বছর। হত্যাকারীরা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিচারের বানী এখনও কাঁদছে নিবৃত্তেই। এভাবে আর কতকাল বিচারহীনতার সংস্কৃতি বহন করবে বাংলাদেশ?