নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে চারজনের নিহতের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ওই মামলায় আসামিদের সংখ্যা উল্লেখ না করে অজ্ঞাত উত্তেজিত অনেক গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান।
মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সকালে থানার উপপরিদর্শক মামুন খান বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। তবে সাতটা পর্যন্ত এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানান ওসি।
তিনি বলেন, ‘ডাকাত সন্দেহে উত্তেজিত গ্রামবাসীর পিটুনিতে চারজন নিহত হয়েছেন এবং একজন এখনও আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলায় অজ্ঞাত উত্তেজিত অনেক গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে আসামি করা হয়েছে।’
এদিকে, ময়নাতদন্তের পর নিহত চারজনের মধ্যে তিনজনের মরদেহ মঙ্গলবার দুপুরে নিয়ে গেছেন স্বজনরা। দু’টি মরদেহ নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল এবং একটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে হস্তান্তর করা হয়। শের আলী (৩৩) নামে এক ব্যক্তির মরদেহ এখনও নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
ওসি কামরুজ্জামান বলেন, শের আলীর স্বজনদের সাথে পুলিশ যোগাযোগ করলেও তারা কোন সাড়া দেননি। রাতের মধ্যে মরদেহ তারা গ্রহণ না করলে আঞ্জুমানে মফিদুলের মাধ্যমে নিহতের মরদেহ দাফন করা হবে।
গত রোববার রাতে সোনারগাঁ উপজেলার বাঘরী বড়বিলে ডাকাত সন্দেহে পাঁচজনকে গণপিটুনি দেয় আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্রামবাসীদের একত্র করা হয়। এতে চারজন মারা যায় এবং একজন আহত অবস্থায় জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন।
দুপুরে নিহত আব্দুর রহিমের ছোটভাই আব্দুর রহমান ও নবী হোসেনের বড়বোন নাজম বেগম দু’জনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে বুঝে নেন।
পেশায় মাছবিক্রেতা আব্দুর রহমান জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি আড়াইহাজার উপজেলার কালাপাহাড়িয়ায় হলেও রহিম গত ১৫ বছর যাবৎ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকতেন সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে। তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
“আমার এই বয়সে আমি কখনও শুনি নাই যে, কেউ রাত নয়টা বাজে ডাকাতি করতে যায়। এই সময় তো মানুষজন এমনিতেই জাগনা (জেগে) থাকে। তার উপর এখন রমজান মাস। তারা যদি ডাকাতি করতে গেলেও তো পুলিশ আছে, এমনে পিটাইয়া কেউ কাউরে মারে না। পুলিশে তো দিতে পারতো তারা।”
কাঁদতে কাঁদতে রহমান বলেন, “আমরা গরীব মানুষ। আমরা জানি না কীভাবে কী করমু? সব গ্রামের লোকজন মিইল্লা মারছে, কার বিরুদ্ধে মামলা করমু? কী হইবো জানি না, কিন্তু আমরা ভাই হত্যার বিচারটা খালি চাই। বিচার পামু কিনা তাও তো জানি না।”
নবীর বোন নাজমা বলেন, “মানলাম, আমার ভাই অপরাধী কিন্তু তার তো এমন মরণ হইতে পারে না। কতগুলা মানুষরে মারছে! এই দেশে কী আইন-আদালত বলতে কিছু নাই? সব কী উইঠা গেছে?
নবী আড়াইহাজারের একটি কার্টন তৈরির কারখানায় চাকরি করতেন বলে জানান তার স্বজনরা। তার ৯ মাসের এক সন্তান রয়েছে। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে একটু পর মূর্ছা যাচ্ছেন বলে জানান তারা।
সোমবার রাত পর্যন্ত শের আলীর মরদেহ অজ্ঞাত হিসেবে মর্গে ছিল। মঙ্গলবার তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি আড়াইহাজার উপজেলার মর্দাসাদী গ্রামের প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। শের আলীর এক ভাতিজার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গ্রামবাসীর আপত্তি ও বাধার কারণে মরদেহ তারা নিতে যাননি।
সোনারগাঁ থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শের আলীর বিরুদ্ধে ডাকাতি ও অস্ত্রসহ অন্তত ৮টি মামলা রয়েছে। ৬ মাস আগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার জামিনে ছাড়া পান। এর দুইদিন পরই গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হলেন তিনি।
শের আলীর ভাতিজা পরিচয় দিয়ে মুঠোফোনে জুয়েল রানা বলেন, শের আলীর বাবা-মা বেঁচে নেই। দুই বিয়ে করলেও স্ত্রীদের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। স্বজন বলতে দুই ভাই ও দুই বোন রয়েছে।
“আমরা সোমবারই ফেসবুকে তার ছবি দেইখা চিনছি। লাশ আনার কথাও ভাবছিলাম। কিন্তু গ্রামবাসী তার লাশ আনতে বাধা দিলে আমরা আর যাইনি।”