সোনারগাঁয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় যুবকের মৃত্যু, গ্রেপ্তার আতংকে দুধঘাটা গ্রাম

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সোনারগাঁ প্রতিনিধি ) : সোনারগাঁয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় হৃদয় ভূইয়া নামের যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার আতংকে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রাম। গ্রেপ্তার এড়াতে গ্রামবাসী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল (১৩ মার্চ) বুধবার পর্যন্ত দুধঘাটা গ্রামে প্রায় পুরুষ পূন্য হয়ে পড়েছে। ওই ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের পুরুষ সদস্যরা। এদিকে ঘটনার পঞ্চম দিনেও দুধঘাটা গ্রামের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়নি। এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বুধবারও ওই গ্রামে পুলিশের একটি গাড়ি অবস্থান করছিল।

ইতোমধ্যে গত মঙ্গলবার ভোরে পুলিশ বিজয়ী প্রার্থীর দুই কর্মী সমর্থককে গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ করেছেন। আদালত তাদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামের কাশেম আলী সরকারের ছেলে শহিদুল ইসলাম সরকার ও ছোট কোরবানপুর এলাকার ফরিদ উদ্দিনের ছেলে হযরত আলী।

এদিকে নির্বাচনী সহিংসতায় হৃদয় ভূইয়া নামের যুবক নিহত হওয়ার ঘটনায় গত রোববার বিকেলে নিহতের বড় ভাই ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় নির্বাচনে সদ্য বিজয়ী ইউপি সদস্য আব্দুল আজিজ সরকারসহ ২১ জনকে আসামী করা হয়। পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত আরো অনেককে। এছাড়াও ফলাফল ঘোষণার পর পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় সোনারগাঁ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফিরোজ আহম্মেদ বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, পিরোজপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে উপ-নির্বাচনে গত শনিবার সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ইউপি সদস্য পদে দুধঘাটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গ্রহন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মোরগ প্রতীকে আব্দুল আজিজ সরকার ও তালা প্রতীকে কায়সার আহম্মেদ রাজু প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। ভোট গ্রহন শেষে আজিজ সরকার মোরগ প্রতীকে ৯২৯ ভোট ও তালা প্রতীকে কায়সার আহম্মেদ রাজু ৮১১ ভোট পান। এসময় ফলাফল জানার পর ওই কেন্দ্রের প্রিজাইর্ডিং কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে পুনরায় ভোট গননার অনুরোধ করেন।পুনরায় ভোট গননা করে রাজুর পক্ষে এক ভোট যুক্ত হয়।

এ নিয়ে রাজুর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। রাজু প্রিজাইর্ডিং কর্মকর্তাকে তৃতীয় দফায় ভোট গননা করতে দাবি করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে রাজূ কৌশলে কেন্দ্রের বাহিরে চলে যান। এ বিষয়টি তার কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা লোকজনকে উপজেলায় আসতে বাধা সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে রাজুর সমর্থকরা ভোটে ব্যবহৃত ব্যালটের বস্তা ছিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশের সঙ্গে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে ফাঁকা গুলি, রাবার বুলেট, টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। এসময় গুলিতে কায়সার আহম্মেদ রাজুর সমর্থক দুধঘাটা গ্রামের আমির আলী ভূঁইয়ার ছেলে হৃদয় ভূঁইয়া ও কামাল ভূঁইয়ার ছেলে ওমর ফারুক (২৭) গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়াও ১২জন আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে হৃদয় ভূঁইয়া মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে গিয়ে পুলিশের ৮সদস্য আহত হন। পুলিশ সদস্যদের সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বুধবার (১৩ মার্চ) সকালে সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে যায়, গ্রেপ্তার আতংকে ওই এলাকায় প্রায় পুরুষ শুন্য। দুই মামলায় দুই শতাধিক আসামী করে মামলা দেওয়ার কারনে ওই গ্রামের পুরুষরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। পুলিশের দায়ের করা মামলায় আসামী অজ্ঞাত থাকার কারনে যে কেউ গ্রেপ্তার হতে পারে এমন আশংঙ্কায় বাড়ি ছাড়া গ্রামের পুরুষ মানুষ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গ্রামের দুজন ষাটোর্ধ্ব প্রত্যক্ষদর্শী ব্যাক্তি জানান, নির্বাচনে ফলাফল শেষে মিছিল নিয়ে আজিজ সরকারের লোকজন বাড়ি চলে যায়। ফলাফল ঘোষনার প্রায় ১০-১২ মিনিট পর নির্বাচনের কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা ব্যালটের বস্তা নিয়ে উপজেলায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। নির্বাচন কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০ গজ যাওয়ার পর পরাজিত প্রার্থীর কয়েকজন লোক ওই বস্তাটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। অনেকেই এদিক ওদিক ছুটাছোটি করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এসময় হৃদয় ভূঁইয়া মারা যায়। তবে পুলিশ ও নিহতের পরিবার স্পষ্টভাবে ভিন্ন কথা বলছেন।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এগিয়ে আসেন কয়েকজন নারী। তাদের সঙ্গে হত্যাকান্ডের বিষয়ে কথা জানতে চাইলে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কথা বলে বিপদে পড়তে চাই না। এমনিতেই আমাদের বাড়ির পুরুষ লোকজন ভয়ে বাড়িতে থাকে না। পুলিশের মামলায় কাকে ধরে নিয়ে জেলে পাঠায় সেই ভয় আছি।

নিহতের বড় ভাই লিটন ভূইয়ার দাবি, নির্বাচনী সহিংসতায় তার ছোট ভাই হৃদয় ভূইয়া কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। নির্বাচন শেষে ফলাফল জানতে গিয়ে আজিজ সরকারের সমর্থকদের গুলিতে মারা যায়। এ হত্যাকান্ডের জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি করেন।
নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী আজিজ সরকারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা রুনার সঙ্গে। তিনি জানান, কাজী ফজলুল হক উইমেন্স কলেজের পরিসংখ্যান বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তার স্বামী গত শনিবার বিজয়ী হওয়ার কর্মী সমর্থক নিয়ে আনন্দ মিছিল করে বাড়ি চলে যান। পরে জানতে পারেন পরাজিত প্রার্থী রাজুর কর্মী সমর্থকরা ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মারা যায়। এঘটনায় নিহতের পরিবার হয়রানী করার জন্য আমাদের কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক মামলা দায়ের করেন। এ মামলার তদন্ত অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমে করার দাবি করছি। সুষ্ঠু তদন্ত হলে গুলির আসল রহস্য বেড়িয়ে আসবে।

সোনারগাঁ থানার ওসি এস এম কামরুজ্জামান পিপিএম বলেন, নির্বাচনী সহিংসতার পর থেকেই আসামিরা পলাতক। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জু করে।

add-content

আরও খবর

পঠিত