নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( ডেস্ক রিপোর্ট ) : সভ্যতার আদি থেকেই ক্ষমতা দখল ও নানামুখী বিরোধের জের ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর এ যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে অনেক নগর এমনকি সভ্যতাও। একের পর এক যুদ্ধ বৈশ্বিক সভ্যতার অগ্রগতিকে করেছে বাধাগ্রস্ত, মানবিকতাকে করেছে বিপন্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য ভয়াবহ যুদ্ধের ভিতর থেকে ভয়াবহতম কয়েকটি যুদ্ধের কথা থাকলো এই আয়োজনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় সভ্যযুগের সর্বপ্রথম অসভ্য যুদ্ধ। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম এ যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় চার বছর। এটি ইউরোপিয়ান মহাযুদ্ধ নামেও পরিচিত ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম যুদ্ধ, যা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণ হারান প্রায় দেড় কোটি মানুষ। আহত হন দুই কোটিরও বেশি মানুষ। এই যুদ্ধে তিনটি সাম্রাজ্যের পতন হয়। সেই সঙ্গে বিশ্ব মানচিত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়।
প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই এবং শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। এই যুদ্ধ মূলত শুরু হয় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় আর সার্ভিয়ার মধ্যে। পরে দুই দেশের পক্ষ হয়ে নানা দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দখল করা এবং আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে কেন বিভিন্ন দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তা বুঝতে হলে আপনাকে নিচের অংশটুকু পড়তেই হবে। ফ্রান্সের ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে ব্রিটেন প্রথমদিকে জার্মানির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। কিন্তু জার্মানি ব্রিটেনের সঙ্গে নৌ-প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। ফ্র্যাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর থেকে জার্মান ও ফরাসিদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ
পৃথিবীতে অনেক জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার নাম রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ। এ যুদ্ধটি ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাশিয়ান সাম্রাজ্য পতনের পর সংঘটিত হয়। যুদ্ধটি মূলত (বলশেভিক রেড আর্মি) এবং (হোয়াইট আর্মি) এর মধ্যে সংঘটিত হলেও বহু বিদেশি আর্মি এ যুদ্ধে রেড আর্মির বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল। এ বৈদেশিক আর্মি গ্রুপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল (আলাইন্ড ফোর্স) এবং (প্রো জার্মান আর্মি)। দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে রেড অ্যালেকসান্ডার কোলচ্যাকের নেতৃত্বে হোয়াইট আর্মিদের পরাজিত করে। এ ছাড়াও ১৯১৯ সালে সাইবেরিয়াতে রেড আর্মিরা হোয়াইট আর্মিদের পরাজিত করে। তা ছাড়াও এ অঞ্চলের বাইরে হোয়াইট আর্মিদের নেতৃত্বে থাকা পিওথর নিকোলাইভিচ র্যানেগেল ক্রিমাতে পরাজিত হন। পরবর্তীতে অনেক স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারী দল এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড মিলে সোভিয়েত স্টেট করেছিল। আর অন্যরা আগের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ধ্যান-ধারণা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল। ভয়াবহতম এ যুদ্ধটি ১৯১৭ থেকে শুরু করে ১৯২১ সাল পর্যন্ত চলছিল। এ যুদ্ধে আনুমানিক ৯০ লাখ লোক প্রাণ হারান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব মানচিত্রকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘতম যুদ্ধটির মাত্র ২৫-৩০ বছর না পেরোতেই আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের খড়গ নেমে এলো শান্তিপ্রিয় পৃথিবীবাসীর কপালে। গোটা পৃথিবী বিস্ময় আর বিহ্বল চোখে তাকিয়ে দেখল আরও একটি ধ্বংসযজ্ঞ। দেখল আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ। এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সভ্য সমাজের সবচেয়ে বড় আর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বলা হয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধে গোটা পৃাথবী লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে। ভয়াবহ এই যুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ মারা যান, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার নাগরিক। নিহতের এই বিশাল সংখ্যার মূল কারণ ছিল গণহত্যা আর অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে একজন ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়। তিনি অ্যাডলফ হিটলার। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। মিত্রপক্ষে ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, রাশিয়া ও গণচীন। জার্মানির সঙ্গে ছিল ইতালি ও জাপান।
দ্বিতীয় কঙ্গোযুদ্ধ
আধুনিক আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম যুদ্ধের নাম দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ। যুদ্ধ যে কতটা রক্তাক্ত, কতটা বিধ্বংসী হতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বয়ে বেড়াচ্ছে দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধ। এই ভয়াবহতম যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল আফ্রিকার সাতটি জাতি এবং সঙ্গে সমরাস্ত্রে সজ্জিত ২৫টি আর্মড গ্রুপ। এ যুদ্ধটিকে অনেকে গ্রেট ওয়ার অব আফ্রিকা বলে অভিহিত করে থাকে। প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ বন্ধের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রথম যুদ্ধের ভয়াবহতাকে হার মানিয়ে ২০০৮ সালে যুদ্ধটি শুরু হয়। প্রথম কঙ্গো যুদ্ধের ইস্যুগুলোকে সামনে রেখেই গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রতিষ্ঠা বা খনিজ সম্পদের ওপর প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুদ্ধটি বাধে। স্বার্থের কাছে অন্ধ হয়ে ভাই ভাইয়ের রক্ত দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করার এ যেন এক অনন্য উদাহরণ। এ যুদ্ধে কমপক্ষে ৫৪ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। আর লাখ লাখ মানুষ নিজেদের সম্পদ-ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়। লাখ লাখ গৃহহীন মানুষের এ যেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়া। খাদ্য আর অপুষ্টিতে ভোগা নিরীহ মানুষগুলোকে দেখলে মনের অজান্তে যুদ্ধকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হবে। অফিসিয়াল হিসাব মতে, ২০০৩ সালের জুলাই মাসে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোয় অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এ যুদ্ধ থেমে যায়।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ
পৃথিবীর ইতিহাসে গণহত্যার জন্য সবচেয়ে কুখ্যাত যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে। এ যুদ্ধ এখনো মানুষকে আন্দোলিত করে, শিহরিত করে আর শান্তির পথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও পরাশক্তি মানা হয় আমেরিকাকে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর ভয়াবহতম যুদ্ধগুলোর সঙ্গে আমেরিকার কোনো না কোনো যোগসাজশ ছিল। তবে তাদের সংশ্লিষ্টতায় অধিকাংশ যুদ্ধেই আমেরিকানরা জয়ের স্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ হচ্ছে প্রথম যুদ্ধ, যাতে আমেরিকা হেরে যায়। এ যুদ্ধকে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংঘটিত সবচেয়ে বড় সংঘাত হিসেবে মানা হয়। এই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল আমেরিকানদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। অর্থাৎ সাম্যবাদী শাসন বা কমিউনিজম যেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে না পারে সে জন্যই আমেরিকা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম আর উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে। মাঝখান থেকে আমেরিকা যুক্ত হলে যুদ্ধ তার গতিপথ পরিবর্তন করে এবং ভয়াবহ রূপ নেয়। আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে ১৯৬৫ সালে সেখানে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু এর ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, তাতে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়।