নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে পেশাদার অপরাধীদের মতই জবানবন্দী দিচ্ছে পিন্টু দেবনাথ। কখনো ৫ জন, কখনো ৪ জন আবার একাই খুন করেছে বলে সে বয়ান দিচ্ছে। ওপেন হার্ট সার্জারীর দোহাই দিয়ে চলছে তথ্য গোপনের নানা অপচেষ্টা তবে পিছু হটেননি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। সার্জারীর বিষয়টি মাথায় রেখেই এগুচ্ছে তারা। গত তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদে এখনও প্রকৃত হত্যাকারী সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয়নি। তবে আজই পুলিশ তাকে আদালতে প্রেরণ করবে, তারপরই সম্পূর্ণ বক্তব্য যাচাই বাছাই করে জানানো হবে নৃশংসতার বিবরণ। তবে এর পিছনেও অনেক রাঘাববোয়ালরা থাকতে পারে যে কারণে মুখ খুলছেনা পিন্টু। কারণ তাদের ভদ্র মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গেলে শেষ বাচাঁর উপায়ন্ত থাকবেনা পিন্টুর। এমন শংকার কথা জানায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবির ঘোষের পরিবার।
তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, এই হত্যাকান্ডে পিন্টুই মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। তার নেতৃত্বেই নৃশংসভাবে খুন হয় র্স্বণ ব্যবসায়ী প্রবির ঘোষ। ব্যবসায়ী প্রবীরকে হত্যার জন্য নিজের বিশ্বস্ত সহযোগী বাপন ভৌমিকের পাশাপাশি আরও তিনজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড পিন্টু। হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হলে পেশাদার খুনিরা নিজেদের সঙ্গে আনা ধারালো অস্ত্রগুলো নিয়ে যায়। আর পিন্টু ঘটনার পর রক্ত ধুয়ে-মুছে ফেলে। আর রক্ত লেগে যাওয়ায় বিছানার চাদর ও বালিশ ফেলে দেয় ঘটনাস্থলের পাশে চোরারগোপ খালে। পিন্টু দেবনাথকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে পিন্টুকে জিজ্ঞাবাদে ইতমধ্যেই বের হয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। টুকরো করে অবশিষ্ট দুই পায়ের অংশ উদ্ধারের পর এবার জানা গেল হত্যা করা হয় পিন্টুর নিজ ফ্লাটেই। এ বাড়িতেই হতো মদের পার্টি। ওইদিনও ব্যতিক্রম কিছু নয় পিন্টুর বাসায় এনে রাখা কোমল পানীয় পান করে, বিস্কুটও খায়। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পিছন থেকেই সে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। এসময় প্রবির জীবন বাচাঁতে লাথিও মারে। তারপর একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে বালিশ চাপা দিয়ে ধরে পাষন্ড বন্ধু পিন্টু দেবনাথ। ঢেকে রাখা হয় চাদর দিয়ে। তারপর ধারালো চাপাতি দিয়ে টুকরো করে বিখন্ডিত করা হয় প্রবিরের নিথর দেহ।
পিন্টু দেবনাথ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বলেন, ঈদ উপলক্ষে শান্ত পরিবেশ থাকা প্রবীর চন্দ্র ঘোষকে ১৮ জুন রাতে পার্টির কথা বলে তার বাসা থেকে বের করি। বাজার থেকে ক্রয়কৃত ৭টি নতুন আকিজ সিমেন্টের ব্যাগে টুকরো টুকরো লাশ ভরি। আরেক ব্যাগে বালিশ, খাটের চাদর, ব্যবহার করা জামা ও দা প্যাকেট করি। পরে ঘরের বাথরুমে রক্তাক্ত ও নিজে গোসল করি। পরিবেশ শান্ত অবস্থায় আনুমানিক সাড়ে ১২টায় বাসা নিচে পরিত্যক্ত সেফটি ট্যাংকটিতে ৫ টুকরো ঢুকাতে শুরু করি। কিন্তু পা ব্যাগটি জায়গা হচ্ছিল না। পরে বাড়ির উত্তর পাশে আবর্জনার স্তূপে সাথে ড্রেনে মাথায় ফেলে দেই। কাজ শেষ করে বাসায় হাত পরিস্কার করে ফের প্রবীর চন্দ্র ঘোষের বাড়িতে রাত দেড়টার দিকে ছুটে যাই। রাতেই শীতলক্ষ্যা নদীতে এসে ফেলে দেই চাপাতি, বিছানার চাদর আর বালিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পিন্টুর দেওয়া তথ্য মতেই রাতেই শহরের কালীরবাজারের একটি হার্ডওয়্যারের দোকান পরিদর্শন করা হয় যেখান থেকে সে চাপাতি কিনেছিল। ওই দোকান মালিক সত্যতা স্বীকার করেছেন। এছাড়া শহরের চারারগোপ এলাকাতে চান্দু অ্যান্ড কোং দোকানের পাশে কামারের দোকানে গিয়ে ওই চাপাতি শান করা হয়। ওই দোকান মালিকও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
মঙ্গলবার রাতেই আমাদের ডিবির একটি টিম পিন্টুকে নিয়ে ওই ফেলে দেওয়া স্থান তল্লাশী করে। সেখান ওই চাদর ও বালিশ পাওয়া যায়নি। কখনো গড়গড় করে কথা বলছে পিন্টু, আবার কখনো বলছে আমি কিছু জানিনা, সব ভুলে গেছি। জিজ্ঞাসাবাদে পিন্টু একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছে। নানা চতুরবাজী চালাচ্ছে বলে জানায় স্বর্ন ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ অপহরণ ও হত্যা মামলার তদন্তকারী ডিবি পুলিশের চৌকশ কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ইসলাম পিপিএম।
তিনি আরও জানায়, আমাদের তদন্ত প্রক্রিয়াধীন, সে যতই চালাকি করুক আমরা এর রহস্য উদঘাটন করবই। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আমরা হত্যাকাণ্ডের আলামত উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে আজ তাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে এরপর আমরা একটি সংবাদ সম্মেলেনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানাবো।
নিহত প্রবীরের ছোট ভাই বিপ্লব বলেন, ঈদের ছুটির কারণে তিনি ঘটনার একদিন আগে কক্সবাজার বেড়াতে যান। সেখান থেকেই বড় ভাই প্রবীর নিখোঁজ হয়েছেন বলে জানতে পেরে ফিরে আসেন। কারও সঙ্গে তার ভাইয়ের কোনো বিরোধ রয়েছে- এমন কিছু তাদের জানা নেই।
প্রবীরের বাবা ভোলানাথ বলেন, পিন্টুর সঙ্গে প্রবীরের ব্যবসায়িক লেনদেন থাকতে পারে। এর বেশি কিছু আমি জানি না।
উল্লেখ্য, গত ১৮ জুন রাতে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন নারায়ণগঞ্জ নগরের কালীরবাজার স্বর্ণপট্টি এলাকার জুয়েলারি ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ। পরদিন বাবা ভোলানাথ সদর মডেল থানায় একটি জিডি করেন। ২১ জুন নিখোঁজ প্রবীরের মোবাইল ফোন থেকে একটি এসএমএস পাঠিয়ে তার ছোট ভাই বিপ্লবের কাছে দেড় কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। নিখোঁজের ২২ দিন পর সোমবার প্রবীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পিন্টু দেবনাথের আমলাপাড়া এলাকার ভাড়া বাসার সেপটিক টাংকি থেকে সোমবার মধ্যরাতে তার খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।