নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে দালালের আড়ালে কে?

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সৈয়দ সিফাত লিংকন ) : নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালালের দৌরাত্ম কমছে না। বিভিন্ন সময় র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে দালালেরা ধরা পড়লেও ঠেকানো যাচ্ছেনা তাদের কার্য্যক্রম। আর দালাল ছাড়া কর্মচারীরা কাজও করে না, ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগ বহু পুরনো।

তবে সম্প্রতি আবোরো পাসপোর্ট অফিসের সামনে থেকে দালাল চক্রের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করার পর সাধারণ মানুষ ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অনেকের মাঝেই প্রশ্ন উঠেছে, এই দালালদের প্রশ্রয় দাতা কারা ? আর কারাইবা আড়ালে কলকাঠি নাড়ায়? কথিত দালালের সাথে যোগসাজোশ করে বিকল্প প্রন্থ্যায় পাসপোর্ট তৈরীতে সহযোগীতা দিয়ে সুবিধা নিতো কারা ?

যদিও ওইসময় দালাল চক্রদের গ্রেপ্তার করার পর সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু জানিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন যাবত আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সামনে দালাল চক্রটি পাসপোর্ট করে দেয়ার কথা বলে সরকারি রাজস্ব থেকেও কয়েক গুণ টাকা বেশি নিয়ে নিরীহ পাসপোর্টধারীদের হয়রানি করে আসছে। তারা ব্যাংক, পুলিশ সহ বিভিন্ন দপ্তরের স্বাক্ষর এবং সীল নকল করে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি কার্যক্রম পরিচালনা করে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদেরকে গেপ্তার করলে জব্দ করা হয় বিপুল পরিমান পাসপোর্ট, নকল সীল, নগদ টাকা ও দলিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। এমনকি তাদের সাথে জড়িত অন্যদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন।

এদিকে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওই অভিযানে সাধারণ গ্রাহক ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে। স্থানীয়রা দিয়েছেন বাহবা। কিন্তু অনেকেই দোষারোপ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদরেকেও। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, যদি পাসপোর্ট অফিসের কর্মর্কতরা গ্রাহকদের সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতো তাহলে দালাল পর্যন্ত যেত না। কেউ কেউ আবার দালালদের সমর্থন দিয়ে বলেছেন, অফিসের স্টাফদের সাথে কথা বলারও সুযযোগ পান না গ্রাহকরা। অনেকসময় ধমকও শুনতে হয়। যে কোন ভুল হলে তা সংশোধনের পরিবর্তে নানা অযুহাত দেখায় কর্মরতরা। এজন্য অনেকেই দালালদের সহযোগীতা নিতে বাধ্য হয়।

এ ঘটনার পর আনোয়ার হোসেন নামে একজন সাধারণ গ্রাহক মন্তব্য করেছেন, দালালদের সাথে অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত। তাদেরকে আগে ধরা উচিৎ। আব্দুস সেলিম সালাম নামে আরেকজন গ্রাহক বলেন, ওদের সাথে যারা জড়িত কর্মকর্তাদেরও গ্রেপ্তারের দাবী জানাচ্ছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানায়, পাসপোর্ট করার জন্য তিনবার অফিসে গিয়েছেন। প্রতিবার ই ফরমে কিছু না কিছু ভুল আছে বলে ঠিক করে নিয়ে আসতে বলেন। তবে তা সঠিক করে দেয়ার জন্য তারা কোন সহযোগীতা করেনা। যে কারণে বাধ্য হয়ে এক লোক মারফত পাসপোর্ট করার জন্য ফরম করে জমা দেন। সেটা জমা নেয়া হয়েছে। তাই তারও দাবী সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে, ভূত কি আর যাবে । তাই তাদের সাথে অফিসের যারা দায়িত্ব অবহেলা এবং দালাল সৃষ্টিকারী মধ্যে জড়িত আছে তাদের খোঁজে শাস্তি দেয়া হোক।

শোখন নামে একজন মন্তব্য করেন, ওদের (দালাল চক্রের সদস্যদের) কোনো দোষ নাই। ওরা থাকাতে আমরা পাসপোর্ট হাতে পাই। ভিতরে কর্মকর্তা সবাই সিন্ডিকেট । দালাল ছাড়া গেলে কাগজপত্র জমা নেয় না। দালালদের একটা স্টিকার থাকে ঐটা দেখলে জমা নেয়। দালাল কর্মকর্তাদের ই সৃষ্ট।

ফারুক আহম্মেদ নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন, দালালের চেয়ে পাসপোর্টের অপারেটররা ( অফিস সহকারী) মানুষ কে বেশী হয়রানি, হেনস্থা ও দুর্ব্যবহার করে । তাদের কাছে ভালো ব্যবহার আশাকরা পাথরে ফুল ফোটানোর মতো । তাদের হাবভাব দেখে মনে হয় তাদের কাজ হলো মানুষের ভুল ধরা, সেবা করা না । কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলতে চায় না, কখনো বা কোন কিছু বললে সেটা ধমকের সুরে ই বলে। নিঃসন্দেহে এই খাতে সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য এই রাজস্ব আয় থেকেই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন অথচ বিনিময়ে জনগন কিন্তু কাঙ্খিত সেবা পায় না । ছোট খাটো ভুল ভ্রান্তি যেমন নিজের নাম, বাবা মায়ের নামের বানান ভুল হলে বিজ্ঞ আদালতের ১ম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে এফিডেভিট আনতে বলা হয় । অনেক ঘোরাঘুরি, অর্থ আর সময় ব্যয় করে সেটা জমা দেওয়ার পরও টালবাহানা করে । নানান কৌশলে শুধু বিলম্ব ও ভোগান্তি বাড়ায় । সুতরাং কিছু সংখ্যক দালাল গ্রেপ্তার করলেই চলবে না, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দুই একজন অফিস সহকারী কে গ্রেপ্তার করলে সেবার মান কিছু টা বৃদ্ধি পেতে পারে ।

এরআগেও ২০২০ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে জেলা এ পাসপোর্ট অফিসের সামনে থেকে ভুয়া সিল, পাসপোর্ট, কম্পিউটার, নগদ অর্থসহ দালাল চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তাার করেছে জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশ । গ্রেপ্তারকৃতরা হল: আল আমিন, মাসুদুর রহমান, আনিছুর জামান, মিলন মিয়া, রিয়াদ হোসেন, মেহেদি হাসান ও আফতাউল ইসলাম। ওইসময়ও তাদের কাছ থেকে ৫টি পাসপোর্ট, ৭৭ হাজার টাকা, ২টি সিল, ২টি ল্যাপটপ, ২টি মনিটর ও প্রিন্টার উদ্ধার করা হয়। তারা জেলার বিভিন্নস্থানের বাসিন্দা। তখন সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) জাহিদ আলম পারভেজ।

একই সালের ১৯ জানুয়ারী সিআইডি নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারী পুলিশ সুপার মো. হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে পাঁচ দালালকে আটক করা হয়েছিল। আটকরা হলো- রিফাত (২০), জুনায়েদ আহমেদ জনি (২৮), আল আমিন (২৩), মনির হোসেন (৩৫) ও রাশেদ (৩২)। তাদের কাছ থেকে ৮৮টি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছিল।

২০১৯ সালে জন্মসনদ তৈরির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জে ছয় জনকে আটক করেছিল র‌্যাব । অভিযানে বিপুল পরিমাণ সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্মসনদ, জন্ম নিবন্ধন তৈরির সিল, সনদের হার্ড কপি এবং সনদের সফট কপির হার্ডডিস্ক উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-২-এর পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী। তাদেরকেও সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়িতে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পাশে তিনটি দোকান থেকে গ্রেপ্তাার করা হয়েছিল। তারা হলো-সিদ্ধিরগঞ্জের সাইফুল ইসলাম (২৪), আজিম হোসেন (২৬), ফজলুল করিম (৩৩), ঢাকা মহানগরীর মাঈন উদ্দিন (৩৮), জাহাঙ্গীর (৩৬) এবং নেত্রকোনার মামুন মিয়া (৩৫)।

এছাড়াও শিশু সন্তানের পাসপোর্ট এর আবেদন করতে গিয়ে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে কানাডা প্রবাসীর সাথে পাসপার্টে অফিসের কর্মকর্তার সাথে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। ওই সময় অফিস সহকারী মহসিন ইসলাম ও প্রবাসী আজমল হোসেন উভয়ই আহত হয়। তাই সাধারণ মানুষ মনে করেন, অধিকতর তদন্ত করে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যদি কোন অসাধূ কর্মকর্তা থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা। তাছাড়াও দালালের দৌরাত্ম কমাতে কঠোর নজরদারীর পাশাপাশি কর্মরত সকলকে সদিচ্ছা ও মানসিকভাবে জনগনকে সেবা দেয়ার জন্য অঙ্গিকারবদ্ধ হতে হবে।

এদিকে নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারি পরিচালক জামাল হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাই এ প্রসঙ্গে তার কোন মন্তব্য জানা যায়নি।

add-content

আরও খবর

পঠিত