নারায়ণগঞ্জে ২২ বছরেও পায়নি ২০ খুনের বিচার

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ (সৈয়দ সিফাত লিংকন ) : আজ ১৬ জুন ট্রাজেডি। শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে শক্তিশালী আরডিএক্স বোমা হামলার ২২ বছর। বর্বরোচিত এবং নৃশংস এ ঘটনায় আহত হয়েছিলেন দলটির জাতীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। নিহতের তালিকায় রয়েছেন ২০ টি তাজা প্রাণ। তবে প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি এসেও বিচারকার্য্য শেষ না হওয়ায় ক্ষুব্দ এবং হতাশায় নিহতের পরিবার ও আহতরা। তাদের অশ্রুজলে এখন একটাই দাবী দোষীদের শাস্তি যেন দ্রুত কার্যকর হয়।

কথা বলে জানা যায়, হতাহত স্বজনদের বুক ভরা আশা। পরপর তিনবার সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় মামলাটির সুষ্ঠু সমাধান হবে, উচিত শাস্তি পাবে প্রকৃত দোষীরা। তবে অভিযুক্তদের কেউ কেউ এখনো উন্মুক্ত ঘুরছে। কেউ দেশ ছেড়ে পলাতক। আবার কেউ পার্শ্ববতী দেশ ভারতেই নাটকীয়ভাবে আটক হয়ে কারাভোগ করছে। তবে এই মামলার বিচারের কাঠগড়ায় দাড়ঁ করানো সম্ভব হচ্ছেনা। এ নিয়ে স্বজনদের ক্ষোভ। ফলশ্রুতিতে আজও অপেক্ষায় কবে শেষ হবে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ মামলার বিচারকর্য্য?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলীয় নেতা ও নিহতদের পরিবারের কয়েকজন স্বজন জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্থ নিহত ও আহত পরবিারের অনেকেই দু:সহ জীবন কাটাচ্ছে। আবার কারো মামা-খালু বা সুপারিশ না থাকায় সেসব পরিবারের ভাই-সন্তান কারো জোটেনি একটি সরকারী চাকুরী। আবার কারো কারখানা ছিলো সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নিজেই অন্য প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছেন। দলীয় নেতারা আফসোস করে বলেন, দল আওয়ামীলীগ থাকলেও আসলেই প্রকৃত আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ও তার পরিবার কতটুকু সুবিধা পেয়েছে। অনেকেই তো ত্যাগ স্বীকার করে ইহকাল ত্যাগ করেছেন। কতটুকু খবর নেন দলীয় নেতারা। তারা দাবী জানান, অন্তত ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের একটি সদস্যকে হলেও যেন সরকারী কিংবা বেসরকারী চাকুরী ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। দল ক্ষমতায় অনেকেই তো বিশাল শিল্পকারখানার মালিকও হয়েছেন, তারা যেন এসব পরিবারের দিকে একটু খেয়াল রাখে।

স্বজনরা জানায়, ঘটনার পর নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও প্রকার মামলা করা হয়নি। তাদেরকে মামলা করতেও দেয়া হয়নি। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির ২৭ জনকে আসামী করে মামলা করা হয়। পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতার আসার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এভাবে বোমা হামলার ঘটনা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে দড়ি টানাটানি খেলায় মেতে ওঠে দুই দল। সবশেষ আওয়ামী লীগ সরকার এ মামলার অনেকটা অগ্রগতি করলেও টানা হচ্ছে না এর ইতি।

মামলায় অগ্রগতি :
ইতমধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্যগ্রহন সম্পন্ন হয়েছে। গুটি কয়েকজন বাকি রয়েছেন। স্বাক্ষ্য দেয়ার মধ্যে ২জন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। বিভিন্ন দপ্তরে তদন্তেই কেটেছে র্দীঘ সময়। পরিবর্তন হয়েছে একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা। একই ঘটনায় দুইটি মমালা রয়েছে। উভয়ের তদন্ত সিআইডি করেছে। সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ১১ মার্চ এ হামলার ঘটনায় ৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শাহ মোহাম্মদ জাকির হোসেন এর আদালতে জামিন প্রাপ্ত ও কারাবন্দি আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। যারা স্বাক্ষী দিয়েছিলেন তারা হলেন : ফারুক, হুমায়ুন হামিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান ( বর্তমানে মৃত ) , মোকারম হোসেন, খালিদ হাসান, হুমায়ুন কবীর, ফরিদ উদ্দিন, তানজিলুর রহমান, শফিকুজ্জামানসহ সর্বমোট ১৬ জন সাক্ষীর স্বাক্ষ্য আদালত গ্রহণ করা হয়েছিল। ওইদিন হাজির করা হয়েছিল এ বোমা হামলার আরেক আসামী শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েলকে। এছাড়াও অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু (জামিন প্রাপ্ত) ও যুবদল নেতা ক্রস ফায়ারে নিহত মমিন উল্লাহ ডেভিডের ছোট ভাই শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল (কারাগারে বন্দি) উপস্থিতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছিল।

মামলা লিপিবদ্ধ :
২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলার ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়াামীলীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বাদী হয়ে পৃথক দুইটি মামলা করেন। মামলায় স্থানীয় বিএনপির ২৭ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে বিএনপির শাসনামলে ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে মামলা দুইটির ফাইনাল রিপোর্টে বলা হয়, উল্লেখিত ২৭ জনের কেউই চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়। যদি ভবিষ্যতে অত্র মামলার তথ্য সম্বলিত ক্লু পাওয়া যায় তবে মামলাটি পুনরজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিএনপির শাসনকালসহ দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য সরকারকে আদেশ দেয়। চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলাটি দীর্ঘ প্রায় নয় বছর পর ২০০৯ সালের মে মাসের ১৬ তারিখে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলা নিস্পত্তি সংক্রান্ত জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা :
২০০৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয় হরকাতুল জেহাদের অন্যতম নেতা মুফতি আবদুল হান্নান। গ্রেপ্তারের পর তিনি র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার নিকট দেয়া জবানবন্দিতে চাষাঢ়া বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি রেল স্টেশন হতে হরকাতুল জিহাদের ২ জঙ্গি সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মুত্তাকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। তারাও বোমা হামলার ঘটনা স্বীকার করেছেন। দুইজনই বর্তমানে দিল্লি কারাগারে বন্দী রয়েছেন। বোমা হামলা মামলার বারো নাম্বার আসামি শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্রস ফায়ারে নিহত মমিনউল্লাহ ডেভিড ও পরিবহন সন্ত্রাসী মাহবুব উল্লাহ তপনের ছোট ভাই। ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর শহরের মিশনপাড়ার বাসভবন থেকে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১১। জুয়েলের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলায় গত বছরের ১০ নভেম্বর শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায় সিআইডি। এছাড়া গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার ৫৩ নাম্বার ওয়ার্ড কমিশনার ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুর রহমান। তাদের কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি।

ভয়াবহ সে কাল রাত :
২০০১ সালের ১৬ জুন শনিবার বিকাল থেকেই চাষাড়া শহীদ মিনার গা ঘেঁষা আওয়ামী লীগ অফিসে তৎকালীন এমপি শামীম ওসমানের গণসংযোগ কর্মসূচিতে দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে জড়িত নেতৃবৃন্দরা জড়ো হতে থাকেন। রাত ৭টার মধ্যে পুরো অফিস লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা কেউ জানতেন না তাদের প্রাণের স্পন্দন কেড়ে নিতে অথবা কারো অঙ্গহানি করার জন্য সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে শক্তিশালী বোমা। হল রুমের একেবারে দক্ষিণ দিকে (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) চার আসনের সাংসদ শামীম ওসমান বসে এলাকার মানুষের কথা শুনছেন। একেকজন একেক সমস্যা নিয়ে আসছেন। কারো চাকরির সুপারিশ, কারো চিকিৎসা সংক্রান্ত তদবির, কারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সমস্যা। হল ঘর পার হয়ে একটি ছোট কক্ষ। সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের খাস কক্ষ। হল ঘরের পরের ঘরটিতে তখন আলোচনায় বসেছিলেন দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ ইউনিয়ন এবং নারায়ণগঞ্জ

জেলা আওয়মী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা।
যেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন, এড. খোকন সাহা, রফিকুল ইসলাম, তৎকালীন চাষাঢ়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি কামাল আহম্মেদ (প্রয়াত), সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব সৈয়দ লুৎফর রহমান (প্রয়াত) সহ কয়েকজন। কয়েক দিন পরেই নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে জনসভা করবেন শামীম ওসমান। সব নিয়ে ওইদন সভার আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সভা শেষ করার কথা শামীম ওসমানের। কিন্তু মানুষের কথা শুনতে শুনতে উঠে আসতে পারছিলেন না তিনি। তাই ফোন করে আনালেন তার পিএস, তৎকালীন কৃষক লীগ নেতা ও বর্তমান মহানগর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দন শীলকে। চন্দন শীলকে দায়িত্ব দেয়ার পর তিনি ভেতরে ঢুকছিলেন সভায় যোগ দিতে। শামীম ওসমান ওঠার পরপরই রাত পৌনে ৯ টায় এতক্ষন তার বসে থাকার স্থানের অদূরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে শক্তিশালী বোমার।

শক্তিশালী বোমায় কেড়ে নিলো যাদের প্রাণ :
বোমা বিস্ফোরণে মুহূর্তেই শরীর দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় সেখানে উপস্থিত অসংখ্য ব্যক্তির। এদের মধ্যে একজন নারীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি। নিহত অন্যরা হলেন : শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সহোদর সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবিএম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েত উল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী ও স্বপন রায়।
বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ ও স্বজনদের আয়োজনে কর্মসূচি :

এদিকে দিনটি পালনে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রতিকী স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হবে। শুক্রবার সকালে শহীদ পরিবারের পক্ষ হতে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভে পুস্পমাল্য অর্পণ করা হবে। এছাড়া দিনভর কোরআন তেলোয়াত ও দোয়া করা হবে। রাতে মোমবাতি প্রজ্জ্বোলনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হবে। অন্যদিকে বিভিন্নস্থানে নিহত পরিবারের স্বজনরা বিশেষ দোয়া এবং কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করে থাকে।

add-content

আরও খবর

পঠিত