নারায়ণগঞ্জে স্বাস্থ্য সেবার নামে চলছে কমিশন বানিজ্য !

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( বিশেষ প্রতিনিধি ) : শহরের খানপুর থেকে শুরু করে নিতাইগঞ্জ সহ বিভিন্ন শাখা সড়কে মাত্র কয়েক কিলোমিটারের পথ হলেও এটুকুর মধ্যেই গড়ে উঠেছে শতাধিক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। সর্বসাধারণের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে রয়েছে দুইটি সরকারী হাসপাতালও। এর মধ্যে একটি হলো খানপুর ৩ শত শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল যা ৫০০ শয্যায় উন্নতি সহ আধুনিকায়নে কাজ চলমান। অপরটি নারায়ণগঞ্জ জেনারেল ১ শত শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল।

এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসে পুরো জেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। তবে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এসব সরকারী হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রয়েছে রোগীদের অনেক অভিযোগ। সঠিকে সময়ে রোগী চলে আসলে দেখা মিলে না ডাক্তারের। সরকারীভাবে রোগীদের ঔষধ প্রদান করার ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসটিক ও সল্প মূল্যের ঔষধই পায় রোগীরা। কিন্তু বেশী মূল্যের ঔষধগুলো ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পছন্দনিয় কোম্পানি হওয়ায় বাহির থেকেই কিনে নিয়ে আসতে হয়।

গলাচিপা এলাকার বাসিন্দা আক্কাস নামে এক ভুক্তভোগী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারী হাসপাতাল কি আসলেই সরকারী? জরুরী বিভাগে গেলে দেখি ডাক্তার ব্যস্ত থাকলে সুইপাররা ইনজেকশন সেলাই দেয়া শুরু করে। এছাড়াও কারো কোনও অপারেশন করাইলে দুই একটা ঔষধ পত্র ছাড়া সবই বাহিরে থেকে নিয়া আসতে হয়। কেনুলা, সেলাইয়ের সুতাটা পর্যন্ত আমাগো দিয়াই আনায়। তাও আবার বেশী আনায় পরে তা রাইখা দেয়। এখানে কিছু অসাধূরা আছে যারা স্বাস্থ্য সেবার নামে কমিশন বানিজ্য চালাচ্ছে।

এদিকে উন্নতমানের চিকিৎসায় স্বাস্থ সেবা নিশ্চিতে সরকারী হাসপাতালগুলো প্রধান চাহিদা থাকলেও শুধুমাত্র নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আনাগোনাই বেশী লক্ষনীয়। আর যাদের অর্থ আছে তাদের অনেকেই চলে যায় বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে। এতে অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের বেহাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। যার অধিকাংশ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেই দক্ষ ডাক্তার, যন্ত্রপাতি, নেই সেবা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।

যে কারণে ভুল চিকিৎসায় অবৈধ গর্ভপাতসহ বিভিন্ন কারণে রোগীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এসব ঘটনায় রোগীর স্বজনদের সাথে ক্লিনিক পরিচালকের প্রায় বাকবিতন্ডা হয়েই চলছে। অনেক প্রতারিত রোগীর আত্মীয় স্বজন রোগধিরা দালালদের খপ্পরে অপচিকিৎসায় রোগীদের নিয়ে বেকায়দায় পড়ছেন। আইনী জটিলতা বাড়াতে না গিয়ে অনেক সময় রোগীর স্বজনরা দেনদরবারের স্বীকার হচ্ছেন রীতিমত। তাই এমনও অভিযোগ উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো গর্জে ওঠা এসব ক্লিনিকগুলো কসাইখানাতে এখন পরিণত হয়েছে। চিকিৎসার নামে এসব ক্লিনিকে যাচ্ছে তাই কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। ভুল চিকিৎসাসহ ডাক্তারের অবহেলা প্রায় সময় মারা যাচ্ছে রোগী।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীও ভাগিয়ে আনার প্রতিযোগিতা চলে এসব ক্লিনিকগুলোতে। তাঁদের নিজস্ব দালাল নগরীর ৩‘শ শয্যা হাসপাতাল এবং জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে। সেসব স্থান থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা হয়। আর বলে দেয়া হয় বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার জন্য।

কিছুদিন আগে চাষাড়ার মেডিস্টার জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপাক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। যা অবশেষে উভয়পক্ষের মাঝে একটি আপোষনামায় শেষ হয়ে যায়। র্সবশেষ ১২ মে চাষাড়ার মুক্তি জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় নুসরাত আক্তার নিরা নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সদর মডেল থানায় একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে আর কোন টু শব্দও নেই পরিবারের।

তখন নিরার স্বজনেরা অভিযোগ করে, সুস্থ শরীরে নিরাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অপারেশনের আগেও সে অনেক কথা বলেছিলো। তাঁর তেমন কোনো সমস্যা ছিলো। কেবল টন্সিল হয়েছিলো। এ কারণে তাঁকে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডা. আহম্মেদ তারেককে দেখানো হয়েছিলো। তিনি অপারেশনের কথা বলে মুক্তি ক্লিনিকে ভর্তি হতে বলেন। আমার সুস্থ মেয়েটাকে তাঁরা মেরে ফেলেছে। এটা হাসপাতাল না কসাইখানা।

সূত্র জানা গেছে, শহরের ক্লিনিকগুলোতে অনাভিজ্ঞ স্টাফ, নার্সরাই ইনজেকশন, স্যালাইন পুষ করে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন কাটা ছেড়াও এরাই করে থাকেন। কোনো রকম অভিজ্ঞতা নেই এদের। নেই কোনো ডিপ্লোমা করা। যার ফলে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। এছাড়াও ক্লিনিক মালিকদের সাথে নগরীর অসংখ্য ডাক্তারদের সখ্যতা রয়েছে। অপারেশন করানো দরকার না হলেও অপারেশনের জন্য ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তারেরা। বিশেষ করে প্রসূতিদের ক্ষেত্রে নানা ভয়মূলক কথাবার্তা বলে সিজারের ব্যবস্থা করে থাকেন। আর প্রতিটি অপারেশন এবং রোগি ভর্তি থেকে আয়কৃত অর্থ থেকে ডাক্তাররাও কমিশন পেয়ে থাকেন। যার ফলে এক শ্রেণির ডাক্তারেরাও ক্লিনিকগুলোর হয়ে দালালি করে থাকেন।

একজন ভুক্তভোগী জয়নাল আবেদীন জানায়, সরকারী হাসপাতালে গেসিলাম। টাকা পয়সাও কম লাগে আর ভালো চিকিৎসা পামু বইলা। কিন্তু ডাক্তার সাহেব এর মনযোগ তেমন একটা পাওয়া যায়না। পরে একজন বলল স্যারের চেম্বারে গেলে ভালো চিকিৎসা পামু। পরে গেসিলাম যাইয়া দেখি আমার পুরা প্রেসক্রিপশন শুধু ঔষধের নাম দিয়া ভইরা ফেলসে। কি আর কমু সেই ঔষধ কিনতে আইসা মানুষ দেইখা এখন অবাক হয়।

এ ব্যপারে  আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নাসির উদ্দিন মন্টু বলেন, সিভিল সার্জনের সঠিক তদারকি না থাকার কারণে নগরীতে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। তাই জেলার সকল নাগরিকের চিকিৎসার স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার কি ভূমিকা পালন করছে তা পর্যাবেক্ষন করা জরুরী। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কিছুনীতিমালা আছে। সেই নিতিমালা অনুযায়ী ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক হয়েছে কিনা তা দেখাশুনা করে সিভিল সার্জেন্ট। সিভিল সার্জন যদি সঠিকভাবে দ্বায়িত্ব নিয়ে  নিয়ম পালন করে তাহলে এসব ধরনের দুর্ঘটনার হওয়ার কথা না।  প্রতিমাসে মনিটরিং টিম পাঠানো উচিৎ।  তাদের ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিক ইত্যাদি ঠিকআছে কিনা তা দেখা। আনারি মানুষ দিয়া চিকিৎসা করালে তো এটা হুমকি স্বরূপ হয়েই। এখানে তো সব পরীক্ষামূলক কাজ চলে। হয়তো ৫টি ভালো হয় ১টি খারাপ হয়। এভাবে তারা অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা.মো.এহসানুল হক বলেন,  ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে সেটা ঠিক নয়। হয়তো আগে হয়েছে কিন্তু আমি আসার পর দুইটি অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে আমাদের তদারকী ও নজরদারী আছে।

সরকারী হাসপাতালে ঔষধ প্রদানের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারী হাসপাতাল পর্যাপ্ত পরিমান ঔষধের ব্যবস্থা আছে। তারপরেও যদি এমন হয় সেখান থেকে ঔষধ না পায় সেক্ষত্রে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ( আরএমও ) ডা আসাদ আছেন তাকে অবগত করবে আর নারায়ণগঞ্জ খানপুর হাসপাতালে এমন হলে তত্ত্বাবধায়ককে জানাবে।

রোগীদের স্বাস্থ ঝুকিঁ ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুও ঘটনার বিষয়ে তিনি জানায়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নুসরাত আক্তার নিরার বিষয়টি নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ রয়েছে। তারা প্রতিবেদন জমা দিলে এর প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

add-content

আরও খবর

পঠিত