নারায়ণগঞ্জে গণপিটুনিতে ২ মাসে ৪ জনের মৃত্যু

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : গত দুই মাসে নারায়ণগঞ্জে গণপিটুনিতে ৪ যুবকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। জেলার ৪ টি থানা এলাকায় পৃথক ৪ ঘটনায় এইসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ২ জন ছিনতাইকারী, ২ জন ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন। দুইটি ঘটনায় মসজিদের মাইক ব্যবহার করে লোক জড়ো করা হয়। অপরাধীকে পুলিশে সোপর্দ না করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার এই ঘটনাগুলোকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

গত বছরের ২২ নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর থানা এলাকার নিতাইগঞ্জের ঋষিপাড়া এলাকায় গণপিটুনিতে মারা যান নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ‘চিহ্নিত ছিনতাইকারী’ শাহাদাত হোসেন ওরফে হাবু (৩০)। মরদেহের পাশ থেকে নিহতের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও একটি ছুরি জব্দ করে পুলিশ।

স্থানীয়রা জানান, শাহাদাতকে তারা হাবু নামে চিনতেন। স্থানীয়দের অনেকেই তার কবলে পড়ে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। স্থানীয় কয়েকজন মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। স্থানীয়দের ভাষ্য, ‘রাত আনুমানিক ১টার দিকে স্থানীয় মসজিদের মাইকে এলাকায় “ডাকাত পড়েছে” বলে ঘোষণা আসে। এরপর লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন শাহাদাতের মরদেহ রাস্তায় পড়ে আছে। পাশে একটি মোটরসাইকেল ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছ।

সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন জানান, নিহত শাহাদাত হোসেন ওরফে হাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ছিনতাই, হত্যা ও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অন্তত ৭টি মামলা আছে।

এই ঘটনার ২ দিন পর ২৫ নভেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দেওভোগ মাদ্রাসা পূর্বনগর এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় গণপিটুনিতে কৃষ্ণা সেন (৩২) নিহত হন। সে চিহ্নিত ছিনতাইকারী ছিল। কৃষ্ণা সেন মাসদাইর গুদারাঘাট এলাকার গিরি চন্দ্র সেনের ছেলে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কৃষ্ণা তার দুই সহযোগীকে নিয়ে করছিলো। এসময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়া লোকজন চিৎকার করলে এলাকাবাসী তাদের ধাওয়া দেয়। বাকিরা পালিয়ে গেলেও কৃষ্ণা ধরে পড়ে। পথচারীদের গণপিটুনীতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

এই দুইটি ঘটনার পর গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ভোরে জেলার আড়াইহাজারে গণপিটুনিতে রায়হান নামে এক যুবক নিহত হয়। উপজেলার হাইজাদী ইউনিয়নের কলাগাছিয়া তাঁতিপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মোহাম্মদ রায়হান (২২) ওই গ্রামের জালালের ছেলে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতে রায়হান তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ওই এলাকার প্রবাসী ফারুকের বাড়িতে চুরি করতে যায়। রায়হান ওই বাড়ির ছাদের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ঘরে থাকা আলমারি ভেঙে মালামাল জড়ো করতে থাকে। টের পেয়ে গৃহকর্তী ঘর থেকে বের হয়ে প্রধান গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে লোক জড়ো করে। এসময় বাইরে থাকা চোরেরা পালিয়ে যায়। কিন্তু রায়হান গৃহকর্ত্রীর বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টি টের না পেয়ে মালামাল জড়ো করায় লিপ্ত থাকে। ওই অবস্থায় উত্তেজিত জনতা এসে তাকে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।

সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় গণপিটুনিতে ৩৬ বছর বয়সী মো. মিলন নামের
এক যুবক নিহত হয়েছেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আটিগ্রাম এই ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক ওই এলাকার কাশেমের ছেলে বলে জানায় পুলিশ।

স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ জানুয়ারি স্থানীয় একটি বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে গত রোববার রাতে দুইজনকে আটক করে পিটুনি দেয়। পরে পুলিশে সোপর্দ করে তাদের দুজনকে।

স্থানীয়দের বরাতে স্থানীয় কাউন্সিলর নূর উদ্দিন মিয়া বলেন, ‘রোববার রাতে যে দু’জনকে ধরা হয়েছিল তারা মিলনের সহযোগী। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দুপুরে লোকজন নিয়ে এলাকায় আসে মিলন। তখন মাইকে ‘ডাকাত পড়েছে’ ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসী সেখানে জড়ো হয়ে তাদের ধাওয়া দেয়। পরে মিলনকে ধরে পিটুনি দেয় এলাকার লোকজন।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই যুবককে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান ঘটনাস্থলে যাওয়া সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মোখলেসুর রহমান।

‘নিহতের হাত ও পায়ে একাধিক ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে, তার হাত ও পায়ের রগ কেটে ফেলা হয়েছিল এমনটাই মনে হচ্ছে’, বলেন তিনি।

তবে নিহত মিলনের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ চারটি মামলা রয়েছে জানিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আপরাধী কর্মকান্ডের জন্য সে আগেও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল।

মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক বিল্লাল হোসেন রবিন বলেন, ‘মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বলবো, অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা মানে হচ্ছে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কেউ যদি অপরাধী হয় তার বিচার আইন অনুযায়ী হবে। কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়।

add-content

আরও খবর

পঠিত