ত্বকীর জন্মদিনের কথা

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : রওনক রেহানা জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির তাঁর ‘নরওয়েজিয়ান উড’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাস্তবতাই প্রিয় মানুষকে হারাবার দুঃখ ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু ঐ বেদনাকে, ঐ শোককে কোন সত্য, কোন সংযম, কোন দর্শন, কোন বুদ্ধিমত্তা ভুলিয়ে দিতে পারে না।’ শোককে বয়ে যেতে হয় আমৃত্যু। শোকেরও ভিন্নতা থাকে। পিতা-মাতা হারানো আর সন্তান হারানোর শোক এক নয়। আবার সে হারানো যদি হয় অসময়ে বজ্রপাতের মতো তা সকল অস্তিত্ব, হিসেব-নিকেশ, চিন্তা-পরিকল্পনা সবকিছু ওলটপালট করে দেয়।

আজ ত্বকীর জন্মদিন। ৫ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে জন্ম। বিজয়া দশমীর ঢাকের বাদনে পৃথিবীতে এলো ত্বকী। মুয়াজ্জিন এসে আযান দিলেন। সদ্যজাত ত্বকী চারদিক তাকিয়ে দেখল জগৎ সংসারের অপার মহিমা-সৌন্দর্য। চারদিকে উৎসবে মেতে আছে বিশ্ব, সকল প্রাণি। আকাশে বাতাসে উৎসবের সমারোহ, কোলাহল। প্রাণময় এক স্পন্দন, সুর ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। পৃথিবী যেন স্বর্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। স্বজন-পরিজনদের মাঝে চলল মিষ্টি বিতরণ। কিন্তু কোলাহল কখন হলাহলে পরিণত হল তা রয়ে গেল অজ্ঞাত।

ত্বকী অর্থ আলো। আলো একদিন ছড়িয়ে যাবে সবখানে, এটাই আমাদের স্বপ্ন ছিল। নির্দয় ঘাতক তা হতে দেয় নি। আমাদের সব সন্তানই আলো ছড়াবে, এটাইতো আমাদের চাওয়া। কিন্তু আলো নিভিয়ে অন্ধকারের এক জগৎ তৈরিতে যারা মেতে রইল তারা কেউই বিচারের আওতায় এলো না, তাদের বিচার হলো না। অপরাধিরা আইনের আওতায় এলো না। সরকার প্রায় একটা যুগ অপরাধীদের সাথেই রইল। আমরা এমন দেশ চাই নি। আজকে পরিবর্তীত সময়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, দেশে সকল হত্যা, গুম, অপরাধের বিচার হবে, মানুষ তার অধিকার পাবে আমরা এইটি চাই। কোন মায়ের বুক খালি হোক তা আর চাই না। আবু সাঈদের মায়ের আর্তনাদ ‘তুই মোর ছাওয়াক মারলু ক্যান’ আমাদের সকল মায়ের বুকে কী ভাবে হাহাকার তোলে তা বোঝানো যাবে না।

ত্বকী বেঁচে থাকলে আজ ৩০ বছরে পা দিত। দেশ-সমাজের হাল ধরতো, মানুষের পাশে দাঁড়াতো। কিন্তু আমার পক্ষে তো আমার সন্তানকে নিরাপদ শহর, জন্মস্থান দেয়া সম্ভব হল না। যে জন্মভূমিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছি ও ভালোবেসেছে, ভালোবেসে এ দেশের জন্য বাঁচতে চেয়েছে। এ-লেভেল শেষে দেশের বাইরে যেতে বললে যেতে চায়নি বলেছে, ‘দেশের শিক্ষা কি এতই খারাপ যে বাইরে যেতেই হবে। দেখো মা আমি দেশেই থাকবো, তোমাদের সাথে থাকবো, এখানেই বড় হবো।’ সতের বছর বয়সে ত্বকী তার একটি কবিতায় লিখেছিল, ‘সমগ্র মানবজাতি আজ এক কাতারে দাঁড়াবে,/ হিংসা বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে,/ জলাঞ্জলি দিয়ে হিসেব কষা,/ ছড়িয়ে দেবে ভালোবাসার গান-/ বলবে মানুষ চাই সমানে সমান।’ একটি সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল ত্বকী। কিন্তু কতটা বিরুদ্ধ সমাজে বসে সে এ স্বপ্ন দেখছে এধারণা হয়তো তার ছিলনা। আমরা দেখি ‘রাজা যায় রাজা আসে’র মতো দেশে সরকার যায় সরকার আসে কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রে কোন বদল আসে না। একটা স্বাধীনদেশে আমদের পরাধীনতা যেন কাটে না।

ত্বকী ‘ডেইলি স্টার’ পুরস্কার নিতে গিয়ে পরিচিতি প্রকাশে জীবনের লক্ষ্য জানাতে গিয়ে লিখেছিল, ‘সততাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লালন করব।’ আঠারো পেরুবার আগে ছোট্ট একটা জীবনে যেখানে শুরুর প্রস্তুতি; সেখানে সিঁড়ি ভাংবার সুযোগ কই! সতের বছর পাঁচ মাসে আটকে আছে ত্বকীর বয়স, তা আর কখনো বাড়বে না। তারপরেও ত্বকীর জন্মদিন আসে প্রতি বছর কেবল আমাদের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তোলার অনুসঙ্গ হয়ে। রওনক রেহানা: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা।

add-content

আরও খবর

পঠিত