নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সৈয়দ সিফাত আল রহমান লিংকন ) : ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন কামার শিল্পীরা। টুংটাং শব্দই বলছে ঈদ লেগেছে কামার পাড়ায়। দিন রাত চলছে চাপাতি, দা, বটি, ছুরি তৈরি ও শানের কাজ। নাওয়া খাওয়া ভুলে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। বছরে তো একটাই সময় কটা দিন মাত্র ব্যস্ত, কুরবানি ঈদের পর তো আর তেমন কোন কাজ থাকে না। তাইতো এই সময়টাকে বেশ উপভোগ করে তারা। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সয়ংক্রিয়ভাবেই চাপাতি, দা, বটি, ছুরি তৈরি তৈরী হওয়ায় আগামীতে এই পেশা টিকবে কিনা এ নিয়ে শংকিত রয়েছে কামার শিল্পীরা।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন বাজার বা কামাড় পাড়া ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যন্ত জনপদের কামাররা এখন মহাব্যস্ত সময় পার করছেন। লাল আগুনের লোহায় কামারদের পিটাপিটিতে মুখর হয়ে উঠেছে কামার দোকানগুলো। টুংটাং শব্দটি তাদের জন্য এক প্রকার ছন্দ। এ ছন্দের তালে চলছে স্বহস্তের জাদুময়ী হাতুড় আর ছেনীর কলা কৌশল।
নগরীর কালির বাজার, দিগু বাবুর বাজার, দেওভোগ, বাবুরাইল, হাজিগঞ্জ, গোদনাইল, সিদ্ধিরগঞ্জ সহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন কামারের দোকানে গ্রাহকের আনাগোনা এখন বেড়েছে। কামাররাও দা, বটি, ছুরি, শান দিতে ব্যস্ত। দোকানের সামনে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রেখেছেন নতুন দা, ছুরি, বটি। মানভেদে নতুন দা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, ছুরি ১০০ থেকে ২০০ টাকা, বটি ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়, জবাই ছুরি ৩০০ থেকে ১০০০ টাকায় এবং ধামা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জানা যায়, ফতুল্লার পুলিশ লাইনস বৃহত্তর লোহার মার্কেট ও স্থানীয় বাজার থেকে লোহা কিনে সেগুলো আগুনে পুড়ে দা, বটি, চাকু, চাপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করছেন কামাররা। বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রাংশের প্রভাবে কামার শিল্পের দুর্দিন চললেও ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে জমে উঠে তাদের এই হস্ত শিল্প।
কামারি হাজী জিহাদ জানায়, এই এক মাসের কাজের উপর তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদেরও লেখাপড়া জামা-কাপড় সহ বছরের খোরাকী নির্ভর করে। যদিও কামার শিল্পের আনুসাঙ্গিক কয়লা ও লোহার দাম লাগামহীন ভাবে উঠানামা করতে থাকে। তাই কামাররা বাপ-দাদার এ পেশাকে ধরে রাখতে কয়লা ও লোহার দাম নিয়ন্ত্রন ও সহজ শর্তে ঋনের দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদ আসলেই আমাদের ব্যবসা চাঙা হয়। গ্রাহকের অর্ডার সামাল দিতে ইতিমধ্যে আমরা দোকানে বাড়তি কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছি। প্রতি কেজি ৯৫ টাকা দরে ২ মণ কাঁচা লোহা কিনে এনেছি। শাণ দেওয়ার যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছে বাড়তি কয়লা ও হাতল। তবে আমাদের ব্যবসা আর আগের মত ভালো নেই। বিদেশী চাইনিজ প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে আমাদের তৈরীকৃত ছুরি, বটি, দা প্রভৃতির চাহিদা কমে যাচ্ছে।
এদিকে কামার ব্যবসায়ীর সাথে একমত প্রকাশ করে ক্রেতা আমজাদ বলেন, আমরা এখন আর একান্তই প্রয়োজন ছাড়া কামারদের দিয়ে কোন কিছু তৈরী করি না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, খুব সল্প মুল্যেই এখন টেকসই চাইনিজ বিভিন্ন চাপাতি, চাকু রেডিমেট কিনতে পাওয়া যায়। এসব পন্যে মরিচা ধরার সম্ভাবনা থাকে না। তাই ছুরি, চাপাতি, দা প্রভৃতি এখন আমরা বাজার থেকে কিনে নেই।
কামার শিল্পীদের কাছে চাপাতি ক্রয় করতে আসা আব্দুল্লাহ বলেন, এই সময়টায় (ঈদুল আযহায়) কোরবানির পশু জবাই দেয়া হয়। যার কারণে কসাই পাওয়া অনেক মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই নিজেরাই কোরবানির পশুর কাঁটাছিলা কাজে লেগে যাই। এ সময় দরকার পড়ে গোশত কাটার জন্য চাপাতি, দা ও ছুরির। আর সেগুলো তৈরি করেন কামাররা। তারা দেশীয় প্রযুক্তিতে লোহা আগুনে গরম করে পিটিয়ে তৈরি করেন দা, ছুরি ইত্যাদি। এখানে নিজেদের সুবিধা মত তৈরী করা যায়। এবং এগুলি খুব টেকশই হয়।
কামার শিল্পী দিলিপ বলেন, সারা বছর এই কোরবানির ঈদের (ঈদুল আযাহা) জন্য অপেক্ষায় থাকি আমরা। এ সময়টিতে যারা কোরবানির পশু জবাই করেন তারা প্রত্যেকে চাপাতি, দা, বটি, ছুরি তৈরি করেন। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে এ সময়টিতে কাজ বেশি হওয়ার কারনে লাভও বেশি হয়। কিন্তু লোহার দাম কিছুটা কম থাকলেও কয়লার দাম বেশি থাকায় মজুরি একটু বেশি নিতে হচ্ছে। এই ব্যবসা এখন আর ভালো নেই। ইতিমধ্যে আমাদের পরিচিত কিছু গ্রাহক দা, বটি, ছুরি বানানোর অর্ডার দিয়ে গেছে এবং শাণ দিতে অর্ডার পেয়েছি। পাশাপাশি নতুন বটি, ছুরি তৈরি করছি। বিশেষ করে কোরবানির ১ থেকে ২ দিন আগেই গ্রাহকের আনাগোনা আরও বেড়ে যায় বলেও জানান তিনি।
তবে এ পেশার ভবিষ্যত নিয়েও তারাঁ এখন চিন্তিত, কারণ এ কাজের সময় আওয়াজ হয় বলে শহরে তেমন কেউ তাদের দোকান ভাড়াও দিতে চায় না। সীমিত আয় দিয়ে তাদের সংসার চলে বলে জানায় দেওভোগ এলাকার কামারি। যেমন পূঁজি নেই তেমনি আয়ও নেই। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আগামীতে এ পেশা টিকিয়ে রাখা খুব কষ্ট হয়ে পড়বে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।