নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সৈয়দ সিফাত আল রহমান লিংকন ) : প্রতিটি শহর-উপশহর জুড়েই রয়েছে লক্ষ লক্ষ বস্তি। প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ নগরীতেও এই বস্তি এবং বস্তিবাসীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। যার মধ্যে অন্যতম র্দীঘ ৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বস্তি হিসেবে পরিচিত নগরীর ফতুল্লা থানাধীণ চানমারী এলাকায় অবস্থিত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড সংলগ্ন চানমারী বস্তিটি। বস্তি এমন একটি শব্দ যা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখের সামনের এমন একটি অস্বাস্থ্যকর এবং অপ্রত্যাশিত বাসস্থানের চিত্র ফুটে ওঠে যা খুব মানবেতর। এই বস্তিতে সুবিধাবঞ্চিত এবং পিছিয়ে পড়া ছিন্নমূল ও দরিদ্র-অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এখানে নগরের নূন্যতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও নেই। অথচ একদিকে নগরের চাকচিক্যময় স্বপ্নিল জীবন অন্যদিকে একদল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অবিরত বেঁচে থাকার লড়াই।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, চাঁনমারি বস্তিতে প্রায় ৪ শতাধিক ছোট বড় ঘড় আছে। এবং বস্তিবাসীর জনসংখ্যার পরিমান সম্পর্কে জনা যায় যে প্রায় ৫,০০০ হাজারের কাছাকাছি মানুষ বসবাস করে। এই বস্তিতে সামপ্রতিকালে যে বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তার অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছে। এবং পার্শ্ববর্তী বস্তিটি উচ্ছেদ করে দেয়ায় কিছু লোক অন্যথায় চলে গেলেও কিছু অংশ এখানে পুনর্বাসিত হয়েছে। এছাড়াও নদী ভাঙন, ছিন্নমূল, পরিত্যক্ত, নিরাপত্তার অভাব, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি বহুবিধ কারণে জীবনের তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসা কিছু মানুষের আবাসস্থল চানমারীর এই বস্তিটি। খুবই অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সরকারি জমির ওপর গড়ে ওঠা এই বস্তিটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও বসবাসের অযোগ্য। এই বস্তিতে সাধারণত মিল-কারখানার শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, পোশাক শিল্পের শ্রমিক, রিকশা ও অটোরিকশা চালক, কাঁচামাল বিক্রি, ঠেলাগাড়ি চালানো, কুলিগিরি, ইট ভাঙা, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ফেরিওয়ালাসহ, হোটেলে কাজ করা, বিভিন্ন পেশাজীবী দরিদ্র মানুষ বসবাস করে। যারা সকলেই দিন আনে দিন খায়। আর তাদের পরিবারে প্রায় বেশিরভাগ সদস্যই উপার্জনমুখি হয়ে থাকে। মেয়েরা হোটেলে ছুটা কাজ বা ঘরে ঝি-এর কাজ করে। এসব কাজগুলি স্ব-নিয়োজিত, অস্থায়ী ও মৌসুমী ধরনের। নারায়ণগঞ্জ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেও এরা বঞ্চিত মৌলিক সব ধরনের অধিকার থেকে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সব কিছুই এদের কাছে যেন বিলাসিতা; জীবনের যেখানে সংশয়।
বস্তিটিতে দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত বসবাসরত দিলিপ সাহা নামের এক নির্মাণ শ্রমিক জানায়, আমাগো বাড়িটা পদ্মা নদীর পারেই ছিল। নদী ভাঙ্গনের কারনে আমাদের ঘর, ক্ষেত সব ভাইসা যায়। সেই ছোটবেলায় আইসি এখানেই বিয়া করসি। ১৩ বছরের এক মেয়ে আছে কিন্তু প্রতিবন্ধি। আমাগো দেখার মত কেউ নাই, মাইয়াটারে ঠিকমত চিকিৎসাও করাতে পারি নাই। তাই আমারা স্বামী স্ত্রী দুজনই যা কামাই তা দিয়া জীবন কাটাইতাসি।
বস্তিবাসীর নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য বিক্রেতা ব্যবসায়ী শাহালম জানায়, বস্তিতে একটি ৮ ফুট থেকে ১০ ফুট ঘরের ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা। এছাড়াও একটি ঘরেই নুন্যতম ৪-৫ জন যৌথভাবে থাকছে। যাদের মাথা পিছু ২৫০-৫০০ টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এই ভাড়ার টাকা দিয়েই বস্তিবাসীর বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যায় হয় বলে জানায় তিনি। এবং এই টাকা দিয়েই তারা গভীর নলকূপও স্থাপন করেছে যার জন্য সকলেই বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে। এই আয় থেকেই অনেকাংশেই সংযোগ স্থাপন রয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। রয়েছে একটি জামে মসজিদ ও শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে ছিন্নমূল শিশুরা বিনা বেতনে পড়াশুনা করছে।
তবে উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, গ্যাস সংযোগবিহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রায় পুরো বস্তিতেই বিদ্যমান। এই পরিবেশেই ঝড়-বৃষ্টি এবং অগ্নিকান্ডের ভয় মাথায় নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় চানমারি বস্তিবাসীকে। বস্তিবাসীরা সুচিকিৎসার অভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে। বস্তিতে নারী, শিশু কিশোরীদের অনেক সময়ই সহিংসতা ও পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও নানা ধরনের উৎপীড়নের শিকার হতে হয়। অবাধে মাদকের কেনাবেচা বস্তির স্বাভাবিক জীবন প্রবাহকে দুর্বিষহ করে তোলে। কিন্তু সদ্য বিদায় প্রাপ্ত র্যাবের আইন কর্মকর্তা ও সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গাউসুল আজমের নিরলশ প্রচেষ্টার বদৌলতে বর্তমানে মাদক কেনাবেচা নেই বললেই চলে। কারন সেখানেই গড়ে উঠেছে তার উদ্যোগে সপ্নডানা নামে অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
পরিশেষে বলা চলে গ্রাম বাংলার হাজার বছরের নদী ভাঙ্গন ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিই এই বস্তি জীবন। এর সাথে যোগ হয়েছে গ্রামীণ অভাব-অন্নের তাগিদ আর বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা। বাসস্থান যেখানে খুপড়ি, স্বাস্থ্য যেখানে স্বপ্ন, শিক্ষা যেখানে বিলাসিতা, যন্ত্রণা যেখানে নিত্যসঙ্গী এরই নাম বস্তি।