কত বিদ্যুত খায় !

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( বিশেষ প্রতিবেদক ) : নেই রেজিস্ট্রেশন পেপার, রুট পারমিট কিংবা বৈধ কাগজ। তারপরেও বীর দর্পেই দাপড়িয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারী চালিত রিক্সা। শুধু তাই নয়, বৈদ্যুতিক চার্জে চলা এসব যানের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে পড়েছে বাড়তি চাপ। প্রতিদিনই হাজার হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ খেয়ে ফেলছে এসব ব্যাটারীতে চালিত রিকশা। এতে বিদ্যুতের অপচয়ের পাশাপাশি লোডশেডিংও এলাকায় বেড়েই চলেছে। তবে এতে নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দেয়া হয়েছে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ থাকা সহ কয়েকটি নির্দেশনা। এরই ধারাবাহিকতায় এ জেলারও বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন ১ থেকে ২ ঘন্টা লোডশেডিং চলমান রয়েছে। তবে বিদ্যুতের উপর বাড়তি চাপ কমাতে অগুনিত ব্যাটারী চালিত রিকশা বন্ধ কিংবা নিয়মে আনার পরামর্শ দিচ্ছে অনেকেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আকার ভেদে কোনটি অটো রিকশা, ইজিবাইক, মিশুক নামেও সাধারণ মানুষের কাছে বেশ পরিচিত যান এটি। কিন্তু ব্যাটারী চালিত এসব অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা যেন দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ এলাকাগুলোতে ৪০ হাজারেরও বেশী ব্যাটারী চালিত রিকশা সড়কে রাজত্ব করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর থানাধীণ এলাকায় ৩ হাজারের অধিক ব্যাটারী চালিত রিকশা রয়েছে। ফতুল্লা থানাধীণ এলাকায় ৪ হাজারের অধিক, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায় ৪ হাজারের অধিক, বন্দর থানায় প্রায় ৬ হাজার, সোনারগাঁয়ে ৫ হাজারের অধিক, আড়াই হাজার ও রূপগঞ্জ উপজেলায় ১৫ হাজারেরও বেশী।

এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার শাখা সড়কে এবং অলিগলিতে রয়েছে এসব ব্যাটারী যানের গ্যারেজ। বিভিন্ন গ্যারেজে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, যেখানে একটি যানকে নুন্যতম ৪টি অথবা বড় যান হলে ৮টি ১২ ভোল্টের ব্যাটারী দিয়ে চালানো হয়। রিকশায় ছাট ব্যাটারী যেটা ট্রাইসেল বা পাউডার ব্যাটারী নামে পরিচিত সেটিতে ৪টি ছোট ব্যাটারী ব্যবহার করা হয়। ৪ ইউনিট খরচ বিদ্যুৎ খরচ পুরাতন ব্যাটারী হলে ১২ এক্স ৪ = ৪৮ টাকা, নতুন হলে ৩.৫ এক্স ১২ = ৪২ টাকা। মিশুক নতুন ব্যাটারী ৮ ইউনিট বিদ্যুত খরচ। ৮ এক্স ১২ = ৯৬ টাকা, ৪টি ব্যাটারী পরিমাণ রিকশার চেয়ে একটু বড়, পুরাতন ব্যাটারী ১০ এক্স ১২ = ১২০ টাকা (পানি বা এসিড ব্যাটারী)। অটো রিক্সা নতুন ব্যাটারী ১০ এক্স ১২ = ১২০ টাকা। পুরাতন ব্যাটারী ১২ এক্স ১২ = ১৪৪ টাকা (ব্যাটারী সংখ্যা ৫টা, উভয় অটো থেকে পরিমাণে আরো বড় যেটা পানি বা এসিড ব্যাটারী নামে পরিচিত) চার্জ হতে সময় লাগে ৮ ঘন্টা। এটা হলো একবার চার্জের হিসাব। কোন কোন গ্যারেজে ২ বার করে চার্জ দেওয়া হয় যেটা ইউনিট ও টাকার পরিমাণ ডাবল। সে হিসেবে ব্যাটারী চালিত যানগুলোকে প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ব্যবহার করা হচ্ছে ১৫শ থেকে ১৭শ ইউনিট বিদ্যুৎ। একেকটি গ্যারেজে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টি ব্যাটারী চালিত এসব যান রাখা হয়। অধিকাংশ গ্যারেজেই আবার বিল থেকে রক্ষা পেতে অবৈধভাবে চুরি করা সংযোগেই চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে সরকার বিদ্যুতের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এরআগে ২০১৮ সালে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ওইসব গ্যারেজগুলোতে অভিযান চালিয়েছে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। অর্ধশতাধিক অটোরিকশার গ্যারেজের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি কোটি টাকার উপরে জরিমানাও করেছে। তবে পরবর্তীকালে এসব অভিযান আর দৃশ্যমান হতে দেখা যায়নি।

সচেতন মহল বলছেন, এসব যান যেহেতু বৈধ নয়। তাহলে অবৈধ এ যান দেশে কারা প্রবেশ করিয়ে বানিজ্য করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক। তা না হলে বৈধ কেরে একটি নিয়মের মধ্যে রেখে চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক। তা না হলে বিশৃঙ্খলায় অবাধে চলাচল করায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশ ও দেশের মানুষ। তাছাড়া বর্তমান সময়ে বিদ্যুতের সংকট এড়াতে ব্যাটারী চালিত রিকশা থামানো না গেলে আর বিকল্প কান পথ থাকবে না।

বিদ্যুৎ অফিস সূত্রে জানা যায়, যে পরিমাণ ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করছে এক একটি অটোরিকশা ও ইজিবাইক ব্যাটারীর ৬ ঘণ্টা চার্জ দিতে হয়। ৬ ঘন্টা চার্জ দিলে গড়ে তিন ইউনিট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। দৈনিক যে পরিমাণ ওইসব যানবাহন চলাচল করছে তাকে গড়ে ১৫শ থেকে ১৭শ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকে লেগে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যানগুলোর প্রথম সমস্যা হলো, এগুলো রিচার্জ করতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, আর দেশে যেখানে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে সেখানে এই যানগুলোতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বিদ্যুতের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।

এ ব্যাপারে ডিপিডিসি ফতুল্লা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইন উদ্দিন জানান, আমরাও চাই বিদ্যুৎ যেন কেউ অপচয় না করে। আর অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকের সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ জরিমানাও করে থাকি।

এদিকে ব্যাটারী চালিত অটো-রিকশার মালিক মিজান বলেন, তিনি প্রবাসে থাকতেন। গত প্রায় ২ বছর পূর্বে দেশে আসা হলে আর সেখানে যাওয়া হয়নি। কোন উপায় না পেয়ে তিনি ৩টি ব্যাটারী চালিত ইজি বাইক ক্রয় করেন। ১টি নিজে চালান ২টি ভাড়ায় চলে। তবে ওই ৩টি যনবাহন বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা না থাকায় তার মাসিক চুক্তিতে গ্যারেজে রাখতে হয়।

ব্যাটারী চালিত ইজি বাইক চালক শহিদ বলেন, অনেক কষ্টে একটি অটো রিকশা কেনা হয়। কেনার পর থেকে তিনি নিজেই এটি চালিয়ে আসছেন। আগে যেখানে বাড়ির ব্যবহারিক বিদ্যুৎ বিল আসতো ৩শ টাকার মতো। কিন্তু অটো রিকশা চার্জ দেওয়ায় প্রতি মাসে বিল আসছে ১৬শ থেকে ১৮ শ টাকা।

অটো চালক মিনির মিয়া বলেন, ভাড়ায় নিয়ে তিনি ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা উপার্জন করেন। এরমধ্যে মালিককে ৪শ টাকা দেন। আর মাঝে মাঝে ট্রাফিক ও সাংবাদিক পরিচয় দানকারী কারো কারোকে কিছু টাকা দিয়ে থাকে।

গ্যারেজ মালিক আলতাফ বলেন, তার এখানে মাসিক চুক্তিতে ব্যাটারী চালিত অটো রিকশা রাখা হয়। প্রতি মাসে একটি যান (রিকশা, অটো রিকশা, মিশুক, ভ্যান) শ্রেণি ভেদে ২শ টাকা থেকে ৫শ টাকা চার্জসহ তাকে ভাড়া দিতে হয়।

ব্যাটারী চালিত রিকশার মালিক ববুল মিয়া বলেন, গত ২ বছর ধরে তিনি গ্যারেজ করে রিকশা রাখছেন। যাদের বাড়িতে জায়গা নেই বা নিরাপত্তার অভাব রয়েছে তারা এখানে রাখছেন বলে জানায়।

এ প্রসঙ্গে ইকরাম হোসেন হিমেল নামে একজন এসব যান বন্ধের দাবী রেখে বলেছেন, সরকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এলাকা ভিত্তিক লোডশেডিং দেওয়ার কথা বলেছেন। সপ্তাহে ১ দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ থাকবে। লোকশান এড়াতে ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী করতে অফিসের সময় কমিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু ভোগান্তির দানব এই অটো রিকশা বন্ধের কোন ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। সময়ের দাবী অভিলম্বে এই অটো রিকশা চলাচল বন্ধ ও অটো রিকশা চার্জের গ্যারেজ বন্ধ ঘোষণা করা হোক।

add-content

আরও খবর

পঠিত