নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : যেদিকে চোখ যাবে, শুধুই ইটের ভাটা দেখা যাবে। এ-যেন ইটখোলার ঘরবসতি। ফসলি জমি, নদীর তীরে সারি সারি ইটখোলা। উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের শুরু থেকে শেষ অবধিই ইটখোলা। দাউদপুরের অধিকাংশ লোকজনই কৃষিকাজের উপড় নির্ভরশীল। ইটখোলার কারণে এ এলাকার কৃষি আজ বিপর্যয়ের মুখে। ইটখোলার বিষাক্ত ধোয়া আর ধূলাবালিতে বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়েছে দাউদপুর। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেষা এককালের ছায়াঘেরা সুনিবিড় দাউদপুর এখন আকাশছোয়া চিমনি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। লোকে এ ইউনিয়নকে ইটখোলার এলাকা বলেই চেনে। এলাকার অধিকাংশ লোকজন নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে বাড়ীঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখানকার ইট পরিবেশবান্ধব নয়। এসব ইটভাটার ইট নিম্মমানের হওয়ায় ক্রেতারা হচ্ছে প্রতারিত।
স্থানীয়রা জানান, দাউদপুরে প্রায় ৪৫ টির মতো ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটা এলাকার ভেতরে ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে। এমনকি বাড়ীঘরের পাশে। তাছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেষে সারি সারি ভাবে ইটেরখোলা। দেখলে মনেই হবে না, এটা একটা ইউনিয়ন। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই এসব ইটখোলা গড়ে উঠেছে। পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ইটখোলার কারণে শুধু পরিবেশই দূষিত হচ্ছে না, নষ্ট হচ্ছে রাস্তাঘাটও। ইটখোলাগুলোতে মাটি বহনকারী ইছারমাথা (ট্রাক্টর) চলাচলের কারণে প্রতিনিয়তই রাস্তা ভেঙ্গে-চুড়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, দাউদপুরের রাস্তাগুলো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০০ ইছারমাথা চলাচল করে। ফলে রাস্তাগুলো ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়। বছরে এসব রাস্তা মেরামত বাবদ খরচ হয় প্রায় কয়েক কোটি টাকা। রাস্তায় গাড়ি কিংবা হেটে গেলে রুমাল চেপে যেতে হয়। আগলা গ্রামের কয়েকজন কৃষক বলেন, স্যার এই গেরামো হগল ধরণের ফসল অইতো। অহন ইটখোলার ধুলা আর ধুয়ার লেইগ্যা ফসলই অয় না। গেরামডা জুইরা ইটখোলা। এগুলাইন বদ্ধ করন স্যার, আমরা দোয়া করমু। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, থানা পুলিশ, মস্তানদের ম্যানেজ করেই অবৈধ ইটখোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রূপগঞ্জ থানা থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পরেই দাউদপুর ইউনিয়নের শুরু। এখান থেকেই শুরু ইটখোলারও। ফসলি জমি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, বাড়ির সীমানায়, নদীর তীর ঘেষেই এসব ইটখোলাগুলো গড়ে উঠেছে। লোকালয় ও নদী থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ইটখোলা করার নিয়ম থাকলেও কেউ তা মানছে না। কৃষি জমিতে ইটখোলা তৈরির আইনগত নিষেধ থাকলেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দাউদপুরে ইটখোলা গড়ে উঠেছে। সরজমিনে দেখা যায়, এসব ইটখোলাগুলোর সামনে কাঠ আর টায়ারের স্তুপ। এসব পোড়ানোর নিয়ম না থাকলেও এ এলাকার ইটখোলাগুলো তা মানছে না। বিষাক্ত টায়ার পোড়ানোর কারণে এলাকার বাতাসও দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ শ্বাসকষ্ট, চর্ম,হাপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এলাকার গাছপালাও মরে যাচ্ছে। ফসলি জমির উর্বর মাটি জোর করে কেটে নিচ্ছে খোলামালিকরা। অনেক ইটখোলা নদী ও খাল দখল করে গড়ে উঠেছে।
দুয়ারা এলাকার রমজান আলী বলেন, কি কমু বাপ? আমাগো কষ্টের কতা কেউ লিহে না। গাছপালা সব মইরা যাইতাছে। কুলসুম বেগম বলেন, ধূলার লেইগ্যা অনেক মাইনষের অসুখ অইতাছে। অনেক মানুষ বাড়ীঘর ছাইড়া যাইতাছেগা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নে প্রায় ৪৫ টি ইটখোলা রয়েছে। দু’একটি ছাড়া এদের অধিকাংশের সরকারি অনুমোদন নেই। নামমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেডলাইসেন্স নিয়ে ইটখোলাগুলো চলছে। ইটখোলামালিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সংগঠন ইটখোলা মালিক সমিতি। প্রশাসন আর পরিবেশ অধিদপ্তরের চাপ এড়াতেই এ সংগঠন।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এসব ইটখোলাগুলোতে প্রায় শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বিগত ২০১২ সালে র্যাব-১১ এর একটি দল দুয়ারা এলাকার একটি ইটখোলায় অভিযান চালিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১২ জনকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করেছে। তবে স্থানীয় ইটখোলার মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য, ইটখোলাগুলো হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। দুয়ারা এলাকার হেলালউদ্দিন ব্রিকসের মালিক হেলালউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরাতো ক্ষতি করছি না। ইটখোলা হওয়ার কারণে মানুষ কাম কইরা খাইতে পারতাছে। ইটখোলা মালিক সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, ইটখোলার কারণেতো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে শিকার করে তিনি বলেন, উপকারের পাশাপাশি কিছুটা ক্ষতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ইসমাঈল হোসেন বলেন, এসব ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমার কোন কর্মকর্তা যদি জড়িত থাকে ব্যবস্থা নিবো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, অননুমোদিত ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে।