নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( নিজস্ব প্রতিবেদক ) : আজ ১৬ই জানুয়ারি রবিবার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন। এবারের নাসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ শেষে কেন্দ্র কেন্দ্রে গণনার পর ফল ঘোষণা করা হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট সব কেন্দ্রের ভোটের হিসেব যোগ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা মেয়র ও কাউন্সিলর পদে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করবেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ একেবারে শেষ প্রান্তে থাকায় এ নির্বাচন তাদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। তাই নাসিক নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা জোরদার করেছে। এরই অংশ হিসেবে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয়েছে সমগ্র সিটি কর্পোরেশন এলাকা। এ পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ ভোটের পরিবেশ প্রত্যাশা করছে নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের এক হাজার ৩৩৩ ভোট কক্ষে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। ভোটের মাঠে মেয়র পদে ৭জন, সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ৩৪ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ১৪৫ জনসহ মোট ১৮৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন।
মেয়র পদে ৭ জন প্রার্থী হলেন : নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী, হাতি প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার, হাতপাখা প্রতীকে সলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাসুম বিল্লাহ, হাত ঘড়ি প্রতীকে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস, দেয়াল ঘড়ি প্রতীকে খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন, বট গাছ প্রতীকে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জসীম উদ্দীন এবং ঘোড়া প্রতীকে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মো. কামরুল ইসলাম (বাবু)।
২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর পর এবার নাসিকের তৃতীয় নির্বাচন হচ্ছে । গত ৩০ নবেম্বর নাসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আজ রবিবার সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট। এর আগে শুক্রবার সব কেন্দ্রে ইভিএমে মক ভোটের মহড়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নাসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ভোট হয় ব্যালট পেপারে। আর ২০১১ সালে প্রথম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৯টি ওয়ার্ডে ভোট হয় ইভিএমে, আর অন্যান্য কেন্দ্রে ভোট হয় ব্যালট পেপারে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নাসিক নির্বাচনই শেষ বড় কোন নির্বাচন। তাই এ নির্বাচনকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে কমিশন। তাই এবার স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা নারায়ণগঞ্জে গিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রার্থী ও ভোটারদের জন্য নিয়েছেন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তিনি বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবই করা হয়েছে। তাই নাসিক নির্বাচন একটি মডেল নির্বাচন হিসেবে উদাহরণ হয়ে থাকবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পর নাসিক নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ইতোমধ্যেই কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে আনা হয়েছে পুরো নির্বাচনী এলাকা। র্যা ব, বিজিবি, পুলিশের স্পেশাল টিম রবোকপ, সাধারণ পুলিশ, আর্মড পুলিশ, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার টিম মাঠে নেমেছে। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে সমগ্র নারায়ণগঞ্জ এলাকা।
নাসিক নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯২টি ভোট কেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫ হাজারের বেশি সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকছে ২৬ জন ফোর্স। এর বাইরে থাকবে পুলিশ ও র্যা বের স্ট্রাইকিং ফোর্স। কোথাও কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ত্বরিত ব্যবস্থা নেবেন। ২৭টি ওয়ার্ডে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে ৩০টি মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। এ ছাড়া ২০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মাঠে কাজ করছে। প্রতি ওয়ার্ডে রয়েছে র্যা বের একটি করে টিম। পুলিশ থাকছে ৩ হাজারেরও বেশি। এছাড়াও পুলিশের মোবাইল টিম থাকবে ৭৬টি, যার প্রতি টিমে সদস্য থাকবে পাঁচজন। আর র্যাবের টিম থাকবে ৬৫টি।
এর আগে ১৫ই জানুয়ারি শনিবার নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মোস্তাইন বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তাই নাসিক নির্বাচন নিয়ে কোন প্রকার আশঙ্কা নেই। আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে। এক প্রশ্নের জবাবে (ডিসি) বলেন, আমরা ১৯২টি ভোট কেন্দ্রকেই গুরুত্বসহকারে দেখছি। ৪টি বাহিনীর সদস্য নিয়ে নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করেছি। তাই ভোটাররা নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারবেন। তবে করোনা বিধিনিষেধ মেনেই সবাইকে ভোট দিতে হবে। মাস্ক বাধ্যতামূলক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং অন্যান্য যে সুরক্ষা সামগ্রী আছে তা প্রতিটি কেন্দ্রেই থাকবে।
শনিবার প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারের কোন সুযোগ না থাকলেও ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা সারাক্ষণ কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে কারা কারা এজেন্ট হবেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আবার নিজেদের অনেক কর্মী–সমর্থক প্রার্থীদের বাসায় গিয়েও যোগাযোগ করেছেন।
এদিকে, ১৫ই জানুয়ারি শনিবার সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি অলি–গলি ও রাজপথের মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ টিমগুলোও সমগ্র শহরে মহড়া দেয়। কোথাও কয়েকজনের জটলা দেখলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে গিয়ে কারণ জানতে চায়।
শনিবার দিনভর নারায়ণগঞ্জবাসীর মধ্যে সকল জল্পনা–কল্পনা ছিল নাসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কে হচ্ছেন মেয়র আর কে হচ্ছেন কাউন্সিলর এ নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে ছিল টানটান উত্তেজনা। তবে শেষ মুহর্তে অধিকাংশ প্রার্থীই ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে কৌশল পরিবর্তন করেন। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রের আশপাশে কর্মী–সমর্থকদের বেশি উপস্থিতি কিভাবে নিশ্চিত করা যায় এবং কিভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা যায় সে জন্যও প্রার্থীরা নিজ নিজ কৌশল কাজে লাগিয়েছেন।
দেশে আবার করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভোটের দিন সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারী বিধিনিষেধ জারি করার পরও তা উপেক্ষা করে নাসিক নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থী ও তাদের কর্মী–সমর্থকরা গণসংযোগ করতে পারলেও প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এবার নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা বুঝে শুনেই ভোট দেবেন। মহানগরের উন্নয়নের জন্য যারা অধিকতর যোগ্য তাদেরই তারা মেয়র ও কাউন্সিলর হিসেবে বেছে নেবেন। তবে মেয়র পদে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সমীকরণ ভোটের ফলে প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে– প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক অবস্থান, নিজস্ব ভোট ব্যাংক, নিজ নিজ দলীয় ভোট, নতুন ভোট, নারী ভোট, ওসমান পরিবারের গতিবিধি, হেফাজত সমর্থিত ভোট, জামায়াতের ভোট, সংখ্যালঘুদের ভোট, শ্রমিক– হকার ও দল না করা ভাসমান ভোট।
এদিকে, আজ রবিবার ভোটের দিন নারায়ণগঞ্জ শহরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ছাড়া চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ১৫ই জানুয়ারি শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. জায়েদুল আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ভোটের দিন নারায়ণগঞ্জে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ চলাচল করতে পারবেন না। এছাড়া ভোটের দিন কোন বহিরাগতকে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের তরফ থেকে নাসিক নির্বাচনে সহিংসতার কোন আশঙ্কা নেই।