নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : মাসদাইর বেকারী মোড় এলাকায় বাকপ্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতেই গৃহবন্দী থাকছে ডলি নামে এক বিধবা নারী। র্দীঘ নয় বছর হলো স্বামী মারা গেছে। এরপরও নিজের সুখের কথা চিন্তাা না করে, বাকপ্রতিবন্ধী শিশু ছেলেটিকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতেই থাকছেন শাহিনা আক্তার ডলি। সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চায় শাশুরি, ভাসুর ও দেবররা। কৌশলে অ্যামেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ভাসুর ও দেবর সমস্ত সম্পত্তি লিখে নিয়েছে। তাতেও ক্ষান্ত হয়নি। এখন, বাড়ি থেকে বের করতে চালাচ্ছে নানারকম চক্রান্ত। কোথায় যাবে স্বামী হারা এই বিধবা ও বাকপ্রতিবন্ধি শিশু। ধর্ণাঢ্য চৌধুরীর বাড়ির বৈধ ওয়ারিশ হয়েও কি তারা পথে পথে ঘুরবে? সেই প্রশ্ন রেখেই ১৮ আগস্ট শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিধবা ডলির বড় ভাই অহিদুল ইসলাম।
সাংবাকিদের সহযোগীতা চেয়ে অহিদুল ইসলাম বলেন, আমি আজ আপনাদের শরণাপন্ন হয়েছি আমার অসহায় বিধবা বোন ও এতিম বাকপ্রতিবন্ধী শিশুর অধিকার আদায়ের জন্য। মানুষ যখন দিশেহারা থাকে তখন জাতির বিবেকদের দ্বারস্থ হয়। আপনারা আপনাদের লেখনির মাধ্যমে সমাজের অনেক অন্যায়কে প্রতিহত করেন। আমি আমার বাবা-মা হারা বোনকে মানুষ করে জমি বিক্রি করে বিয়ে দিয়েছি। স্বামী যতদিন ছিলো ততদিন সে সুখেই ছিলো। সম্পত্তির লোভে তার শশুরবাড়ির লোকজন তার উপর মানসিকভাবে অত্যচার করছে। তার বাকপ্রতিবন্ধী সন্তানকেও তার অধিকার না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে। যা সম্পূর্ণ অমানবিক। বোনকে যখন বিয়ে দেই তখন সম্পত্তির মালিক আমার বোনের শশুর ও শাশুড়ি ছিলেন। বোনজামাই ব্যবসা করতেন আর তার দুই ভাই তখন চাকুরি করতেন। আয় বেশী ছিলো আমার বোনজামাইয়ের।
একান্নবর্তী সংসার হওয়ায় আমার বোনজামাইয়ের আয় বেশী থাকায় সে সংসারে খরচ বেশী করতো। যা নিয়ে আমার বোনের কোন আপত্তি ছিলোনা। বাড়ি নির্মাণেও আমার বোনজামাই টাকা খরচ করেছে। সে মারা যাওয়ার পর ২০১৩ সালে আমার বোনের দুই প্রবাসী ভাসুর ও দেবর সম্পত্তি লিখে নেয়। দু’টি দান দলিলে লেখা হয়েছে, তারা তাদের বাবা-মাকে সেবাযতœ করেছে তাই তাদেরকেই সম্পত্তি লিখে দিয়েছে। আমার প্রশ্ন, তারা বিদেশ থেকে কীভাবে সেবাযতœ করলো। আর আমার বোনজামাইতো এখন মৃত। তিনি আর কীভাবে সেবাযতœ করবেন। আমার ভাগ্নে রাফী একজন বাকপ্রতিবন্ধী শিশু। যেখানে সরকার এই ধরনের শিশুদের জন্য নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সমাজের সব সচেতন মহল এইধরনের শিশুদের বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেন। সেক্ষেত্রে রাফীর সাথে যা করা হচ্ছে তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত। এই প্রশ্ন রাখলাম জাতির বিবেকদের কাছে। আপনার আপনাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে এক অসহায় মা ও বাক প্রতিবন্ধী শিশুর এই অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হবেন বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
শহীদ হানিফ খান মিলনায়তন নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসময় উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ মানবধিকার কমিশনের ঢাকা বিভাগিয় গভর্নর কে ইউ আকসির, নারায়ণগঞ্জ মহিলা পরিষদের সভাপতি লক্ষী চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক এড. হাসিনা পারভিন, কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি আঞ্জমান আরা আকসির, নারায়ণগঞ্জ জেলা মানকধিকার কমিশনের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন মন্টু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে ডলির বড় ভাই অহিদুল ইসলাম জানায়, ২০০৮ সালে ফতুল্লার মাসদাইর বেকারী মোড় এলাকার আজমল চৌধুরীর মেঝো ছেলে শাহাদাৎউল হক চৌধুরী শরীফের সাথে বন্দর মদনপুরের মৃত আবুল হোসেনের মেয়ে ও আমার বোন শাহিনা আক্তার ডলির বিয়ে হয়। ২০০৯ সালে কোলজুড়ে আসে শফিকুল হক চৌধুরী রাফী। জন্ম থেকেই বাকপ্রতিবন্ধী রাফীর বয়স এখন নয় বছর।
বিয়ের সময় আমাদেরকে জানানো হয়, ওই বাড়িতে থাকা ভবন ও সাড়ে ১৭ শতাংশ জায়গার মালিক আজমল চৌধুরী ও তার স্ত্রী মাকসুদা খানম। দলিল অনুযায়ী ৩৮৫/৩৮৬ নং দাগে ২ টি দলিলে ১৯৭৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সামসুল হকের কাছ থেকে সাড়ে ১৭ শতাংশ জায়গা কিনেন আজমল চৌধুরী ও তার দুই ভাই আছাদুল হক এবং মাহফুজুল হক। ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল আমার বোনজামাই শরীফ মারা যায়। এর প্রায় ১ মাস পর ২৯ জুন শুক্রবার বিকেলে আমার বোনজামাই মরহুম শরীফের অধিকাংশ টাকায় স্থাপিত ৫ তলা দালানের সম্পূর্ণ দোতলা ২০৩০ বর্গফুট ফ্লোরটি আজমল চৌধুরী কয়েকজন স্বাক্ষির সামনে মৌখিকভাবে ডলি ও তার সন্তান রাফীকে দান করেন।অহিদুল ইসলাম জানায়, আজমল চৌধুরী ও মাকসুদা দম্পতির ৫ ছেলের মধ্যে মো. আজাদুল হক চৌধুরী ( আরিফ), ও মো. ফরিদুল হক চৌধুরী (শ্যামল), চাকুরি করতেন। আমার বোনজামাই শরীফ ছিলেন শহরের করতোয়া মানি এক্সচেঞ্জের একজন অংশিদার। শরীফের টাকায় আরিফ আমেরিকা ও শ্যামল অস্ট্রেলিয়ায় যায়। আজমল চৌধুরী অবসর গ্রহনের পর থেকে শরিফই গোটা পরিবার দেখাশুনা করতেন। অপর দুই ছেলে সানাউল্লা হক চৌধুরী (তমাল), মুসফিকুল হক চৌধুরী ( তাপস ) এখনো বেকার। ৫ তলা দালান নির্মাণের জন্য ডলির স্বামী শরীফ ২০ লক্ষ টাকা খরচ করেন। শরীফ মারা যাওয়ার পর তার ব্যাংকে থাকা ৩০ লক্ষ টাকা নমিনী হওয়ার কারনে তার মা মাকসুদা আত্মসাত করেছে। ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি ( ডলি ও রাফীকে দোতলা দান করার ৬ মাস পর ) রাতে একা বাথরুমে যাওয়ার সময়ে আজমল চৌধুরী ফ্লোরে পরে যেয়ে রক্তাক্ত জখম হয় ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে ডলি তাকে ডাক্তার দেখাইয়া চিকিৎসা করে বাড়িতে আনলেও আজ পর্যন্ত সে কাউকে চিনতে পারেনা, হাত দিয়ে কিছুই ধরতে পারেনা। বর্তমানেও এ অবস্থায় আছেন। এরপর থেকে অসুস্থ আজমল চৌধুরীকে ডলি দেখাশুনা ও সেবা করে আসিতেছেন।
ডলির বড় ভাই জানায়, চলতি বছর ৬ জানুয়ারি শাশুড়ি মাকসুদা, দেবর তমাল ও তাপস ডলিকে জানায়, দালানসহ গোটা বাড়ি প্রবাসী আরিফ ও শ্যামলকে লিখে দেয়া হয়েছে। তোমরা আর এ বাড়িতে থাকতে পারবেনা। অন্য কোথাও গিয়ে ব্যবস্থা করো। এ কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে স্বামী হারা ও এক বাকপ্রতিবন্ধী সন্তানের মা ডলির মাথায়। ডলি জানতে চায়, আমার স্বামী মারা গেছে। আমার মা-বাবাও নেই। আমার একমাত্র শিশু সন্তানটি বাকপ্রতিবন্ধী। এ অবস্থায় আমাকে আমার স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দিলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো। তখন তারা সবাই একই রকম উত্তর দেয়, তোমরা কোথায় যাবে তা আমরা কী জানি।এরপর থেকেই নানা অত্যাচার চলতে থাকে তাদের উপর। ১৪ জুন সকালে রাফীকে পাশের ফ্লাটের একজনের জিম্মায় রেখে ওর জন্য কাপড়চোপড় কিনতে শহরে যায় ডলি। ফিরে এসে দেখেন ডলির রুমে থাকা স্বামীর রেখে যাওয়া আলমারীতে থাকা ১২ লক্ষ টাকা, সোনাদানা, সোয়া লাখ টাকা মুল্যের খাট নিয়ে গেছে শাশুড়ি ও দুই দেবর। এর বদলে একটা পুরাতন ভাঙ্গা খাট ডলি ও রাফীর রুমে রেখে গেছে। এরপর ডলি ও তার ক্রন্দনরত বাচ্চাকে নিয়ে রুমে ঢুকলেও রুমে তালা লাগিয়ে দেয় মাকসুদা ও তাদের সহযোগী মজিবর।
অহিদুল ইসলাম আরো জানায়, ১৯ জুলাই ফতুল্লা থানার একজন এসআইকে নিয়ে এসে ডলিকে বাড়ি ছাড়তে হুমকি দেয়া হয়। এ সময় তার মোবাইল ফোনের চার্জার কেড়ে নেয়। এরপর থেকে মানবেতর ও অনেকটা গৃহবন্দী জীবনযাপন করছে ডলি ও তার বাকপ্রতিবন্ধী শিশু রাফী। তারা বাড়ি থেকে বের হলেই আর তাদের ওই বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হবেনা, এই ভয়ে তারা বের হতে পারছেনা। তাদের সাথে কাউকে দেখা করতে হয়না। গত ২৫ জুলাই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি নেতৃবৃন্দ ওই বাড়িতে গিয়ে ডলি ও রাফীর করুণদশার সত্যতা পান। পরের দিন এনায়েতনগর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সদস্য এবং গ্রামের বিশিষ্টজনরা ওই বাড়িতে গিয়ে ডলি ও রাফীকে দেখে আসেন। তারা আরিফ,তমাল ও তাপসকে বিষয়টি সামাজিক মীমাংসার প্রস্তাব দিলেও তাতে সাড়া দেয়নি আরিফ গং।
পরবর্তীতে কোন উপায় না দেখে নিজের ও সন্তানের ন্যয্য অধিকার ফিরে পেতে বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা জজ ২য় আদালত, নারায়ণগঞ্জ এ দেওয়ানী মোকদ্দমা করেছেন শাহিনা আক্তার ডলি। এ মামলার বিবাদিরা হলেন মাসদাইর বেকারী মোড় এলাকার আজমল হক চৌধুরী, তার স্ত্রী মাকসুদা খানম, তাদের ছেলে মো. আজাদুল হক চৌধুরী ( আরিফ), মো. ফরিদুল হক চৌধুরী (শ্যামল), সানাউল্লা হক চৌধুরী (তমাল), মুসফিকুল হক চৌধুরী ( তাপস ), একই এলাকার জিসান-জিদান ভিলার মালিক মো. মজিবর রহমান ও সাব রেজিস্টার ফতুল্লা।