নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সৈয়দ সিফাত লিংকন ) : সময় তখন রাত ২টা। ফেসবুক মেসেঞ্জারে সাংবাদিক বাঁধন ভাই আমাকে একটি বিভৎস ছবি পাঠালো। আর বললো আজকে একটি ডোবা থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে। ছবিটা তুমি একটু দেইখো তো। সে ছবিটা নিয়ে বারবার ভাবতে লাগলাম। ছবিটায় ব্যক্তির গায়ে যে চেক শার্ট পড়া, তা অনেকটা শুভ্রর সাথে মিল রয়েছে। হাতের ভাজও ভাঙ্গানো, শার্টটাও অনেক ছোট। যেমনটা শুভ্র পড়তো। তারপর চুল গুলো প্রায় উঠে রয়েছে। তবে ছোট। লম্বায় প্রায় শুভ্র’র মতই উচ্চতা। আমি তখন তার বন্ধু গোলাম মোহাম্মদ শিমুল কে কল দিয়ে বললাম তোমার মেসেঞ্জারে ছবি পাঠালাম।
আর বললাম, দেখেতো এটা দেখে কিছু বুঝা যায় নাকি। যদিও ছবি দেখে কিছু বেঝার নাই। শার্ট, প্যান্ট, জুতোটা শুভ্রর সাথে মিল আছে নাকি জানতে চাই। শিমুলও অনেকটা হতভম্ব, ফোন দিয়ে বলছে। ভাই আপনার কি মনে হচ্ছে। আমার যেটা মনে হচ্ছে। আমি চাই সেটা যেন না হয়। আর আমি তোমাকে বলতেও পারছিনা। তবে আমার ধারণা ভুল ই হবে। কিন্তু তুমি নিশ্চিত করো। কারণ তুমি ওর বিষয়ে ভালো জানো।
শেষ পর্যন্ত বাধঁন ভাই ফোন দিয়ে চলে আসে আমার অফিসে। কারণ এরআগের দিন সকাল থেকেই শুভ্র নিখোঁজ। এ নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। ওইসময়টায় আমি, ফরিদ আহম্মেদ বাধঁন ভাই সহ নতুন হিসেবে যুক্ত হয়েছিল শাহরিয়াজ মাহমুদ শুভ্র, গোলাম মুহাম্মদ শিমুল, শামীমা রিতা, আফরিন, পিয়াল সহ বেশ কয়েকজন। সকলেই তখন একটি স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করি। কিন্তু হঠাৎ যখন শুনতে পাই। শুভ্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর থেকে আর কেউই মনস্থির রাখতে পারিনি।
তাই সারাদিনে নিউজের কাজ শেষ করেও রাতেই আমি, বাধঁন ভাই আর শিমুল শুভ্রকে নিয়েই ভাবছি। অনেক খোজঁ নিলাম কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। কেউই বলতে পারছেনা! শুভ্র কোথায় গেল?
সবশেষ রাত জেগে ওই ছবি নিয়েই ভাবলাম। পরবর্তিতে শিমুলকে দিয়ে শুভ্র’র পরিবারকে জানাতে বললাম। পরদিন ভোরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে গিয়ে সে লাশটি শুভ্রের তা নিশ্চিত করেন তার বাবা কামাল সিদ্ধিকী।
এরপর থেকে শুরু হয় অনেক নাটকীয়তা। সে অনেক কথা। যা অনেক কিছু বলাও সম্ভব না। চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছিল শুভ্র’র মুখখানি। যে ছেলেটি সারাক্ষণ আমার পাশে থেকে কাজ করতো। শিখার এতোটা আগ্রহ ছিল। যা এখনো আমাকে ভাবায়। কম্পিউটারের কী-বোর্ডে যেকোন প্রতিবেদন লিখার জন্য ও ছিল আমার বেস্ট হ্যান্ড।
পরবর্তিতে শুভ্র’র মৃত্যুর জন্য সন্দেহজনকভাবে তারই দুই বন্ধুকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যাদের মধ্যে একজন ছিলো সাংবাদিক শিমুল। চোখের সামনে সে ছেলেটি তার বন্ধুকে হারিয়ে নিস্তব্দ, সেও আটক। রাতে কয়েকবার ফোন দিলে দায়িত্বরতরা বলেছেন একঘন্টা পর ছেড়ে দেয়া হবে। তার সাথে বসে কথা বলা হচ্ছে। এমনি করে রাত চলে যায়। ওইসময় কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকেও দুই একজনের বাহিরে অন্যদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতেও দেখিনি। যদিও সেদিন থেকে সাংবাদিকতা পেশায় অনেকটা খারাপ অভিজ্ঞতা চলে এসেছে। পরের দিন ছেলেটি অনুরোধ করে বন্ধু শুভ্রর জানাযাটাও দিতে পারেনি ।
এরপর থেকে আমি যখন জানাযা দিতে যাই। সবকিছু তখন শুধু পর্যবেক্ষণে ছিলাম। কারণ ওইসময় শুভ্রই একমাত্র আমাকে ভালো চিনতো। তার পরিবারের সাথেও কখনো আমার যোগাযোগও হয়নি। কারণ আমি এমনিতেই ফরমালিটি মেইনটেইনের দিকে একেবারেই পিছিয়ে। তবে পরে শুনেছি তার বাবা-মায়ের কাছে আমার কথাও বলতো। যা শুনে এখনো বুক ফেটে কান্না আসে। সেদিন থেকে এখনো শুভ্রকে স্মরণ করি। তবে প্রতিবছর এই দিনে নয়। যখনই কী-বোর্ডে লিখতে যাই। যখনই ছিনতাইয়ের কোন নিউজ লিখি। এমন হাজারো স্মৃতিতে শুভ্র আমাকে মনে করিয়ে দেয়। সেদিনগুলোর কথা।
সকাল থেকে পুরোটা দিন এই তরুণদের নিয়ে। নানা হাসি-ঠাট্টা, গল্প, ভাগ করে খাওয়া-দাওয়া করা। ওদের ফাকিবাজি’র জন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার থেকে নানা কথা শুনলেও খুব সহজেই মেনে নিতাম। ওদের সাথে কাজ করে এতটা ভালো লেগেছে। যা বলার ভাষা নেই। ওই টিমের সকলেই ভালো আছে। শিমুল এখন প্রথম আলোতে কাজ করে। আফরিন সংবাদে। রিতা এখন ঢাকা ট্রিবিউনে আছে। সাহিত্যমনা পিয়ালও এখন ভালো ফ্রিল্যান্সার, অসাধারণ ভিডিও তৈরী করে নিজের মেধাকে বিকশিত করছে। তবে আমাদের সকলের মাঝে শুভ্র নেই । তাই আর লিখতে পারলাম না। ওরে নিয়ে এতো কথা জমা রয়েছে। যা লিখার মতো সামর্থ, শক্তি আর হচ্ছে না। বুকটাও ভারি হয়ে আসছে। শুধু দোয়া করি ভালো থাকো। ভালো থাকুক তোমার পরিবার। কারণ এর বাহিরে কোন কিছু করার সামর্থ যে আমার নাই।