নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( নিজস্ব প্রতিনিধি ) : নারায়ণগঞ্জ জেলার আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুু এখন বন্ধু প্রবীর হত্যার ঘাতক কিলার পিন্টু দেবনাথ। শহরের আমলাপাড়াস্থ স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষ হত্যাকান্ডের পর একে একে বের হয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। প্রথমে নিখোঁজের ২১ দিন পর প্রবীরের ৭ টুকরো মরদেহ উদ্ধার। হত্যাকারী পিন্টুর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বিকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানা যায়, বন্ধু প্রবীরকে হত্যা করা হয় ৩টি কারণে। যা হলো বন্ধকী স্বর্ণ ও অর্থ আত্মসাত, নারী কেলেংকারী (তৃতীয় পক্ষ বড় ভাইয়ের কু-প্ররোচনা) ক্ষোভে হত্যা করার পর একাই বাথরুমে বসে ৭ টুকরো করে প্রবীরের মরদেহ।
এদিকে সাংবাদিকদের ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর একটি খুনের রহস্য উন্মোচন হতে না হতেই, এর সূত্র ধরেই আরেক খুনের সন্ধানে অগ্রসর হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। প্রায় ২১ মাস আগে ২৭ অক্টোবর ২০১৬ বিকেলে নিতাইগঞ্জের কাচারি গলির নিজ বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি স্বপন। সে মৃত সোনাতন চন্দ্র সাহার ছেলে। তবে স্বপন নিখোঁজ নয়, গুমের শিকার হয়েছে তথ্য পায় ডিবি পুলিশের চৌকশ অফিসার প্রবীর হত্যাকান্ডের তদন্ত কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম পিপিএম। তার পাষন্ড বন্ধু পিন্টু দেবনাথই স্বপনকে হত্যার পর লাশ গুম করার লক্ষ্যে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিয়েছে। আরো ২১ মাস আগেই সে এ কাজটি নিখুতভাবে সম্পন্নও করেছে ।
অপরদিকে শহরের আলোচিত কাপড় ব্যবসায়ী স্বপন কুমার সাহা হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে রতœা রাণী চক্রবর্তী ও আবদুল্লাহ আল মোল্লা মামুন। এর মধ্যে রতœা আদালতকে জানিয়েছে পিন্টু দেবনাথের সঙ্গে বিরোধের জের ধরেই রত্নার বাড়িতে স্বপনকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। তাকে হত্যার পর লাশ ৭ টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
১৯ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেলে পৃথকভাবে নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশেক ইমামের আদালতে গ্রেফতারকৃত রতœা রাণী চক্রবর্তী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল মহসীনের আদালতে গ্রেফতারকৃত আবদুল্লাহ আল মোল্লা মামুনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়।
গ্রেফতারকৃত রত্না আদালতকে জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ শহরের মাসদাইর বাজার কাজী বাড়ির প্রবাসী আজহারুল ইসলামের ৪ তলা ভবনের ২য় তলায় রত্মা রাণী চক্রবর্তীর ফ্ল্যাট বাসায় স্বপনকে পিছন থেকে শিল পুতা দিয়ে আঘাত করে রতœা ও পিন্টু। পরে অচেতন অবস্থায় টয়লেটে নিয়ে তাকে ৭ টুকরো করে। ব্যাগে ভরে স্বপনের দেহ অংশগুলো পিন্টু ঠান্ডা মাথায় ভবনের পাশে খালি স্থানে রাখে। পরে সুযোগ বুঝে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয় পিন্টু।
তাদের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানা গেছে, পিন্টু তার প্রেমিকা রত্মা রানীকে দিয়ে স্বপনকে যৌন মিলনের প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নেয় তার ফ্ল্যাটে। কাপড় ব্যবসায়ী স্বপন, স্বর্ণব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষ ও স্বর্ণ ব্যাবসায়ী পিন্টু এরা তিনজনই ছিলেন একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর রত্মা রানী ছিলেন পিন্টুর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। বিয়ে আশ্বাস দিয়ে রত্মা রানীর কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা ধার নেয় পিন্টু। এরপর থেকে রত্মা রানী প্রায় সময় পিন্টুর ফ্ল্যাটে যাতায়াত করত এবং তাদের মধ্যে অবৈধ যৌন মেলা মেশা চলত।
আরো জানা যায়, পিন্টুকে ভারতে বাড়ি কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখায় স্বপন। একটি ফ্ল্যাটও পিন্টুর টাকায় স্বপন তার ভাগ্নির নামে কিনে দেয়। তখন পিন্টুকে স্বপন বলেছিল ভারতে নাগরিত্ব করিয়ে তার ফ্ল্যাট বুজিয়ে দিবে। কিন্তু তা না করে পিন্টুকে ঘুরাতে থাকে স্বপন। একই সঙ্গে প্রবীর ঘোষের সাথে মিলে পিন্টুকে নানা ভাবে হয়রানী করতে পরামর্শ করে স্বপন। সর্বশেষ প্রায় বছর খানেক আগে বড় ভাই আল মামুনকে প্রবীর ঘোষের বাসায় ডেকে নেয় স্বপন। এরপর স্বপন ও প্রবীর ঘোষ মিলে পিন্টুকে নারী দিয়ে ফাসাতে আল মামুনের সঙ্গে পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনার কথা পরের দিনই পিন্টুকে ডেকে নিয়ে বলে দেয় মামুন।
একই সঙ্গে প্রবীরের ব্যাপারে পিন্টুকে মামুন প্রশ্ন করেছিল, প্রবীর তোর বন্ধু না শত্রু? পিন্টু নির্দ্বিধায় প্রবীরকে বন্ধু বলে স্বীকার করলে মোল্লা মামুন নিজেই পিন্টুকে চড় মারে ও গালি দিয়ে বলে প্রবীর তোর বন্ধু না। এরপর মোল্লা মামুন ফোন করে প্রবীরকে। মোবাইলে লাউড স্পিকারে পিন্টুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই প্রবীর বলেছিল, ওরে মাইয়া লোক দিয়া… কইরা র্যাব দিয়া ধরাইয়া দেন দাদা। ওর টাকা পয়সা বাইরা গেছে, অর্ডারও বাইরা গেছে। ওর দোকান আমার লাগব। এমন কথা শোনার পরই ক্ষোভ সঞ্চার হয় পিন্টুর মধ্যে।
এরআগে স্বপন দাস নিখোঁজের ঘটনায় সদর মডেল থানায় সোমবার (১৬ জুলাই) বিকেলে তাঁর বড় ভাই অজিত কুমার দাস বাদী হয়ে চারজনকে আসামী করে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় পিন্টুর বান্ধবী রতœা চক্রবর্তীকে প্রধান আসামী করা হয়। এছাড়াও আসামী করা হয়েছে প্রবীরের হত্যাকারী পিন্টুু দেবনাথ, তার সহযোগী বাপন ভৌমিক ওরফে বাবু ও মামুন মোল্লাকে।
মামলার এজাহারে বাদী অজিত কুমার সাহা জানান, স্বপন কুমার সাহা ছিলেন খুচরো কাপড় ব্যবসায়ী। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে সে নিখোঁজ রয়েছে। পরে স্বপনের বন্ধু কালীরবাজার এলাকার পিন্টু দেবনাথকেও জিজ্ঞেস করি। কিন্তু পিন্টু বলে আসছিলেন স্বপন ভারত চলে গেছে। গত ৯ জুলাই প্রবীর ঘোষের লাশ উদ্ধারের পর পিন্টুর প্রতি আমাদের সন্দেহ বাড়ে। পরে ১৫ জুলাই বিষয়টি ডিবিকে জানালে রিমান্ডে থাকা পিন্টুর সহযোগি বাপন ভৌমিক বাবু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। সে তখন পিন্টুু দেবনাথের এক বান্ধবী রত্মা রাণী চক্রবর্তীর সন্ধান দেন। তার মোবাইল নাম্বার পর্যালোচনা করে জানা গেছে স্বপনের মোবাইলটি রত্মা ব্যবহার করছে।
এ ঘটনায় পিন্টুর বান্ধবী রতœা চক্রবর্তী ও আমলাপাড়া এলাকার মৃত মহসিন মোল্লার ছেলে মামুন মোল্লাকে রোববার (১৫ জুলাই) মধ্য রাতে গ্রেফতার করা হয় । এরমধ্যে রতœার কাছ থেকে নিখোঁজ স্বপনের মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়েছে।
জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ইসলাম পিপিএম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, প্রবীর হত্যায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরমধ্যে পিন্টুর জবানবন্দীতে প্ররোচনাকারী হিসেবে মামুনের নাম ওঠে আসে। এছাড়া রতœার কাছ থেকে নিখোঁজ স্বপন দাসের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়েছে। জবানবন্দীতে তাঁদের কাছ থেকে স্বপন হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
এরআগে মামুন ও রত্নাকে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশেক ইমামের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে শুনানি শেষে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন।
এছাড়াও পিন্টুর ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিলো। এমন ব্যক্তির পক্ষে একা একজন সুস্থ সবল মানুষকে হত্যা করা অবিশ্বাস্য। তাছাড়াও প্রবীর হত্যার পর আলোচনা ওঠেছিলো পিন্টুর দেবনাথের ওস্তাদ অপু কর্মকারের বিষয়টি। গুঞ্জন ওঠেছে, এই অপু কর্মকারকেও এর আগে হত্যা করা হয়েছিলো। এরপর তাঁর ছেলে রনিকে হত্যা করা হয়েছিলো। এবং এসব হত্যার নেপথ্যে ছিলো পরকীয়া প্রেম। আলোচনায় রয়েছে, অপু কর্মকারের স্ত্রী শীলা রানীর সাথে পিন্টু দেবনাথের পরকীয়া সম্পর্ক ছিলো। আর এর জের ধরেই অপু ও তাঁর ছেলে রনিকে হত্যা করা হয়েছিলো।
সার্বিক বিশ্লেষনে অনেকেই ধারণা করছেন এবং স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রবীর হত্যার সূত্র ধরে যখন স্বপন দাসের হত্যার বিষয়টি বের হয়ে এসেছে তখন অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত করলে অপু কর্মকার এবং তাঁর ছেলে রনির বিষয়টিও বের হয়ে আসতে পারে। তবে এর জন্য দরকার শীলা রানীকে আইনের আওতায় আনা। নরপিচাশ পিন্টুু আসলে পেশাদার অপরাধীতে পরিণত হয়েছে। তার পাপের পাল্লা এবার অনেক ভারী হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে এটা অনুভব করতে পারেনি পাপ ছাড়েনা বাপরে!