নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( নিজস্ব সংবাদ দাতা ) : নারায়ণগঞ্জে একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট বাসায় মা ও ৭ মাসের অন্ত:সত্ত্বা মেয়েকে টাকা ও সোনাদানার জন্যই কুপিয়ে খুন করেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য দিয়েছে গ্রেফতার হওয়া যুবক জুবায়ের। ১লা মার্চ মঙ্গলবার রাতে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জুবায়ের আরও জানিয়েছে, নিহত মা-মেয়ে ও তার পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু বলেন, টাকা ও সোনাদানা লুট করতে মা ও অন্ত:সত্ত্বা মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি জানান জিজ্ঞাসাবাদে জুবায়ের বলেছেন, তাঁর নিজের চলার জন্য টাকার দরকার। এ কারণে নিতাইগঞ্জের সবচেয়ে বড় বাড়িটি তিনি টার্গেট করেন। পরে তিনি ওই বাড়ির ৬ তলায় রাম প্রসাদ চক্রবর্তীর ফ্ল্যাটে কংলিবেল চাপেন। এ সময় ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রুমা চক্রবর্তী দরজা খুললে ভেতরে ঢুকে তাকে গলা চেপে ধরেন জুবায়ের। ছিনিয়ে নেন রুমার গলার চেইন। এরপর ছুরি মেরে রুমাকে হত্যা করেন তিনি। এক পর্যায়ে রুমার মেয়ে অন্ত:সত্ত্বা ঋতু চক্রবর্তী এগিয়ে এলে তাঁকেও ছুরি মেরে হত্যা করেন জুবায়ের।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আরও বলেন, এ সময় পাশের রুমে অবস্থানরত রাম প্রসাদ চক্রবর্তীর ছেলের বউ শীলাকে কোপাতে গেলে তিনি ধাক্কা দেন। এতে জুবায়ের ঘরের মেঝেতে থাকা রক্তে পা পিছলে পড়ে যান। তখন শীলা দৌড়ে বঁটি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসেন। জুবায়েরও নিচে নেমে আসেন। শীলার হাতে বঁটি ও নিচে অনেক লোক দেখে জুবায়ের আবার ওই ফ্ল্যাটের ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। পরে পুলিশ তাঁকে রক্তমাখা ছুরিসহ আটক করে। এ সময় জুবায়েরের ব্যাগ থেকে দুটি সোনার চেইন ও কানের দুল উদ্ধার করা হয়েছে।
জানা যায়, জুবায়ের একজন ব্যবসায়ী ছিল। করোনার কারণে ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ার পর থেকে সে বিষন্নতায় ভুগছিল। টাকার জন্যই সে ওই ফ্ল্যাটে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। মঙ্গলবার দুপুর তিনটার দিকে মা রুমা চক্রবর্তী (৪৬) ও মেয়ে ঋতু চক্রবর্তীরকে (২২) হত্যার পর জুবায়ের তাদের পুত্রবধূ ফারজানাকে হত্যা করতে বটি নিয়ে হামলা চালায়।
তখন পুত্রবধূ তার হাতের বটি কেড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ভবনের নিচে গিয়ে ডাকাত বলে আর্তচিৎকার করে। এসময় ব্যবসায়ীরা ওই ভবনের প্রধান গেট বন্ধ করে দিলে হত্যাকারী জুবায়ের আটকা পড়ে। পরে স্থানীয়রা ৯৯৯ নাম্বারে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে মা-মেয়ের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে।
এসময় পুলিশ রক্তমাখা গ্লাভস পরা অবস্থায় জুবায়েরকে গ্রেফতার করে। এসময় ওই ফ্ল্যাট থেকে একাধিক হ্যান্ড গ্লাভস, ধারালো তিনটি ছুরি, একটি বটি উদ্ধার করা হয়। জুবায়ের স্বীকার করে জানিয়েছে টাকার জন্যই তাদের হত্যা করেছে সে।
নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, এই ঘটনায় আটক জুবায়েরকে তিনি চিনেন না। স্ত্রী ও কন্যাকে সে কেন খুন করেছে সেই সম্পর্কেও কোন ধারনা দিতে পারছেন না ।
তিনি বলেন, আমি ভাবতেও পারি নাই এইরকম কিছু আমার পরিবারের সাথে হবে। আমি গরীব মানুষ। কারও সাথে কোন শত্রুতা নাই। আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করি।’
তিনি জানান, তার দুই সন্তান ঋতু ও হৃদয় চক্রবর্তী। হৃদয় নগরীর মাসদাইর এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। সম্প্রতি তিনি ফারজানা নামের এক মুসলিম তরুণিকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর হৃদয় ধর্মান্তরিতও হয়েছেন। ঘটনার সময় তার পুত্রবধূ ফারজানা ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন। তবে তিনি আহত হননি। তার আর্ত চিৎকারেই স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেন।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমীর খসরু জানিয়েছেন, মা ও মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া যুবক জুবায়ের রাতে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে হত্যাকাণ্ডের শিকার মা-মেয়ে ও তার পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। সে তাদের চেনে না। আসামি জুবায়ের স্বীকার করে বলেছে টাকার জন্যই সে মা-মেয়েকে হত্যা করেছে। গ্রেফতার হওয়া যুবক জুবায়ের নগরীর পাইকপাড়া এলাকার আলাউদ্দিনের ছেলে। সে পেশায় ব্যবসায়ী। নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ চক্রবর্তীর ডালপট্টি এলাকায় একটি পাইকারী ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজারের চাকরি করতেন এবং মেয়ে নিহত ঋতু চক্রবর্তী চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শ্যামল ভট্টাচার্যের স্ত্রী।
এদিকে, জুবায়ের ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। পরে আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি বলে পুলিশের কাছে দাবি করেন।
উল্লেখ্য, এর আগের দিন ১লা মার্চ মঙ্গলবার বিকালে শহরের নিতাইগঞ্জে ডালপট্টি এলাকায় স্বপন দাসের মালিকানাধীন মাতৃ সদন নামে একটি ৬ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে মা ও মেয়েকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন : রুমা চক্রবর্তী (৪৬) ও তার মেয়ে ৭ মাসের অন্ত:সত্ত্বা ঋতু চক্রবর্তী (২২)। নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ চক্রবর্তী স্থানীয় একটি পাইকারি আড়তে ম্যানেজারের চাকরি করেন।
ফ্ল্যাট বাসায় মা ও মেয়ের খুনের ঘটনায় দুইজনের মধ্যে একজনের মরদেহ মেঝেতে ও অপরজনের মরদেহ অর্ধেক খাটের উপর ছিল। পুরো ফ্লোর ছিল রক্তমাখা। ওই ঘটনায় রক্তমাখা ছুরিসহ জুবায়ের নামে এক যুবককে এলাকাবাসীর সহায়তায় আটক করেছে পুলিশ। সে পাইকপাড়া এলাকার বাসিন্দা বলে জানা যায়। তবে আটক নারীর নাম তদন্তের খাতিরে প্রকাশ করেনি পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, ওই যুবক দুই জনকে কুপিয়ে ও জখম করে হত্যা করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, আটক জুবায়ের দুপুর পৌনে ৩টার দিকে শহরের নিতাইগঞ্জে ডালপট্টি এলাকায় স্বপন দাসের মালিকানাধীন ভবনটিতে প্রবেশ করেন। আধাঘণ্টা পর রক্তাক্ত ছুরি নিয়ে এক নারীকে নামতে দেখে সন্দেহ হলে নিচ তলার একটি আড়তের কর্মচারী ওই নারীকে আটকে বাইরে থেকে মূল ফটক বন্ধ করে আশপাশের লোকজনকে খবর দেন।
এরপর পুলিশে খবর দেওয়া হলে স্থানীয় ৪ যুবক ও পুলিশ ওই ভবনের ছয় তলায় উঠলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করা অবস্থায় দেখতে পান। এরপর দরজা ভেঙে প্রবেশ করলে সেখানে মা ও মেয়ের লাশ মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর ফ্ল্যাটের ড্রইং রুমের দরজা ভেঙে জুবায়ের নামে ওই যুবককে হাতে গ্লাভস পরিহিত অবস্থায় রক্তাক্ত ছুরিসহ আটক করে পুলিশ।
এদিকে, নিহত রুমা চক্রবর্তীর স্বামী রাম প্রসাদ চক্রবর্তী জানান, আমি এখানেই একটি দোকানে কাজ করি।আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই বা ছিলও না। কেন এ হত্যার ঘটনা সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি খবর পেয়ে এসে দেখি সব শেষ। আমার বাড়ির নিচে ও ফ্ল্যাটে পুলিশ। আমি এই হত্যার বিচার চাই।
তিনি আরও জানান, আমার মেয়ে ৭ মাসের অন্ত:সত্ত্বা। যে এখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি তার কি দোষ ছিল। এটা তো দুইজনকে হত্যা নয় একসাথে তিনটি জীবন কেড়ে নিয়েছে ঘাতক। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে কয়েক মাস আগে থেকেই আলাদা থাকে। আমার মেয়ে অন্ত:সত্ত্বা থাকায় সে আমার বাড়িতে এসেছিল।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহজামান বলেন, মা ও মেয়েকে খুন করা হয়েছে। খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে দুইজনকে আটক করি। নিহতদের শরীরে ছুরির আঘাতের অনেক চিহ্ন রয়েছে। তবে তদন্তের প্রয়োজনে এখনই সব বলা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃত জোবায়ের খুনের কথা স্বীকার করেছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরু জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে জুবায়ের নামে এক যুবককে আটক করা হয়েছে। তিনি বিক্ষিপ্তভাবে নানা তথ্য দিচ্ছেন। প্রয়োজনে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঘটনাস্থলে জেলা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি এসেছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হবে।
তিনি আরও জানান, ঘটনার সময় প্রত্যক্ষদর্শী নিহত রুমা চক্রবর্তীর একমাত্র পুত্রবধূ দৌড়ে নিচে নেমে আসেন। তার দেওয়া তথ্যমতে, খুনি তাকেও ধাওয়া করে।