ছয় লেন সংস্কারে মরণ ফাঁদ

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( বিশেষ প্রতিবেদক ) : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে ৬ লেনের সংস্কার কাজ চলছে। সংস্কার কাজ চলার সময় প্রকল্প এলাকায় সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শর্ত থকলেও তা মানছেন না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (এনডিই) ন্যাশনাল ডেভলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেড । তাই সড়কে যানবাহন চলাকালীন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির পে-লোডারে বোঝাই করা ইট-পাথর চলন্ত মোটর সাইকেলের আরোহীর মাথায় ফেলে দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। তবে হেলমেট পরিধান করা থাকায় এতে তারা কোনরকম প্রাণে রক্ষা পেলেও যানবাহনে ক্ষয়ক্ষতি এবং আহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও পুরো সড়ক জুড়ে খানাখন্দ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করায় যানবাহন উল্টে ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে চরম বিপাকে পড়েছে এ সড়কে চলাচলকারী সাধারণ পথচারীও। তবে এসব বিষয়ে কোন তদারকীই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না সড়ক ও জনপদের কর্মকর্তাদের।

জানা গেছে, ১০ এপ্রিল বিকালে মোটর সাইকেলযোগে সাইনবোর্ড থেকে চাষাঢ়া যাচ্ছিলেন দুইজন পেশাজীবী। ওইসময় সাব রেজিষ্ট্রি অফিস সংলগ্ন প্রধান সড়কে মোটর সাইকেলে চলন্ত অবস্থায় তাদের উপর পে-লোডার থেকে ইট পাথরে ভর্তি নির্মাণ সামগ্রী ফেলে দেয়া হয়। মুহুর্তের মধ্যেই মোটর সাইকেল ও আরোহীরা সেই ইট-পাথর ও মাটিতে ঢেকে যায়। আর আশে পাশে থাকা যানবাহনের দূর্ঘটনার কবল থেকে বেঁচে সামনে গিয়ে ছিটকে পড়ে। এসময় তাদের উভয়ের মাথায় হেলমেট থাকায় বড় দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। তবে শরীরের অন্যান্য স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং মোটর সাইকেলটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

ওইসময় ভুক্তভোগীরা পে-লোডারের অপারেটর আল আমিনকে দেখালে সে তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের শিহন তালুকদারের সাথে কথা বলতে বলেন। তিনি ঘটনাস্থলে মোটর সাইকেলে এসে অপারেটর আল আমিনের ভুলের বিষয়টি স্বীকার করে নেন। পরে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের আরেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিহর এসে সুরক্ষা নিশ্চিত করে কাজ করার বিষয়টি আশ্বস্ত করেন।

এ ঘটনার প্রসঙ্গে কথা হলে নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন দু:খ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এভাবে কাজ করা তো ঠিক নয়। অবশ্যই সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিষয়টির জন্য দু:খিত। আমি তাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো।

এদিকে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ৬ লেনে উন্নীতরণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়াদ বাড়ানো হলেও বর্ধিত সময়ের মধ্যেও নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রকল্পটির বর্ধিত মেয়াদের সময় বাকী থাকলেও এখনো বাস্তবায়ন বাকী রয়েছে প্রায় ৪০ ভাগ। এরই মধ্যে একর প্রায় ২ কিলোমিটার অংশের জমি এখনো অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। যে কারণে অনেকটাই শম্ভুক গতিতে চলছে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম। এতে করে সড়কটিতে চলাচল করতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভাঙ্গাচোরা সড়কের পাশাপাশি ৮ কিলোমিটার সড়কে ধুলোবালিতে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য ৮.১৫ কিলোমিটার। এটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (লিংক রোড) নামেও পরিচিত। সড়কটি নারাণগঞ্জ জেলা শহরকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই সড়কের পাশেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জন অফিস, জেলা নির্বাচন অফিস, জেলা পরিষদ, এলজিইডি, জেলা কারাগার, গণপূর্ত অধিদফতর, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ অফিস, বিজিবি-৬২, পিবিআই অফিস, পরিবেশ অধিদফতর, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, যুব উন্নয়ন অধিদফতরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। এছাড়া সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলা বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার ভেন্যু হিসেবে সমাদৃত ছিল। ঢাকার পাশের এই অঞ্চলে অসংখ্য শিল্পকারখানা ও নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। ফলে বিদ্যমান সড়কে যানবাহন সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ১১ বছর পূর্বে নানা সদর ও বন্দর উপজেলার একাংশ নিয়ে এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত কয়েক বছরে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরে বেসরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানসহ বড় আকারের বেসরকারি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এছাড়া লিংক রোডের উভয়পাশে রপ্তানীমুখী গার্মেন্টসসহ নানা শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। যে কারণে লিংক রোডটি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ। তবে ৫০ ফুট চওড়া সড়কটির বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পনার অভাবে যানজট লেগেই থাকতো। গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটির প্রস্থ খুবই ক্ষীণ। সড়কটি যে আয়তনের তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে এ সড়কে। এসব কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ লিংক রোডটি যথাযথ মানে উন্নীত করার জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে ডিপিপি প্রণয়ন করে প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।

সূত্রমতে, প্রকল্পটির প্রস্তাব পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ৮ জুলাই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেয় সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়। পরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হলে সেটির অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর সড়কটি ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্যাকেজ কাজের ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন পায়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (আর-১১১) ছয় লেনে উন্নীতকরণে অনুমোদিত প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩৬৪ কোটি ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭ টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই), তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড এবং হাসান টেকনো ব্রাদার্স লিমিটেড। এখানে লিড পার্টনার হিসেবে থাকছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড। ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৮ কিলোমিটার ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কটি ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়। পরবর্তীতে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়েছে ৪৪৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় নির্ধারণ করা হয়।

অন্যদিকে, সড়কের অংশাবিশেষে চলছে সংস্কার ও নির্মাণ কার্যক্রম । সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকায় সড়কের একাধিক স্থানে দুইলেনে চলছে যানবাহন। সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়ায় যানবাহন চলাচলে ক্ষণে ক্ষণে সৃষ্টি হচ্ছে লম্বা যানজট। সড়কের অধিকাংশ স্থান খানাখন্দে ভরা। সড়কে কেটে সড়কের কার্যক্রম চালিত অধিকাংশ স্থানে চলাচল নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। কিন্তু এসব স্থানে মাসের কয়েকদিন কাজ চলমান রইলেও অধিকাংশ দিন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তাই যানজটও এখন যেন নিত্যদিনের ভোগান্তি হয়ে দাড়িয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, জালকুড়ি সংলগ্ন সড়কে অর্ধ শতাধিক এলপিজি সিলিন্ডার সহ একটি ট্রাক সড়কের গর্তে আটকে পড়ে। এরফলে জালকুড়ি থেকে জেলা কারাগার পর্যন্ত সৃষ্টি হয় লম্বা যানজট।

তাছাড়া, লিংক রোড সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রথম মেয়াদ ফুরালেও প্রকল্পের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ অবশিষ্ট রয়েছে। সড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে একাধিক বিপাকে পড়েছেন বলে জানান সড়ক ও জনপদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সড়কের পার্শ্ববর্তী গ্যাস লাইন, বৈদ্যুতিক খুঁটি সময় মতো সড়ানো যাচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ। বৈদ্যুতিক খুঁটি রেখে সড়কের কাজে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে। সড়কের অধিকাংশ ভূমি বেদখলে থাকায় সড়ক সম্প্রসারণের প্রকল্পের কার্যক্রম কচ্ছপ গতিতে চলছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদ বিভাগ।

add-content

আরও খবর

পঠিত