আজ বক্তাবলী গণহত্যা দিবস

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : আজ ২৯ই নভেম্বর, বক্তাবলী গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে আজকের এই দিনে দেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠিক তখনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চল বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামে।

বর্বরোচিত ওই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ১৩৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি নারী কিংবা শিশু। রাজাকার, আল-বদররা জ্বালিয়ে দিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসে ২৯ নভেম্বর দিনটি নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য বেদনাবিধুর দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে একসঙ্গে এত মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি আর নেই।

বক্তাবলীর মানুষ শত শত মুক্তিযোদ্ধার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সঙ্গে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে পালিয়ে আসা শত শত পরিবারের আশ্রয়স্থল ছিল বক্তাবলী। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র ১৭ দিন আগে ঘটে বক্তাবলীর হৃদয় বিদারক হত্যাযজ্ঞ। স্বজন হারানোর ব্যথা ও কষ্ট নিয়েও শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতি বছরই পালিত হয় এই দিবসটি।

বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীবেষ্টিত বক্তাবলী এলাকা মুক্তিযুদ্ধের সময় পরগনা ছিল। এখন সেটি ভেঙে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শষ্যভান্ডারখ্যাত বক্তাবলীতে ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর ভোরে হানা দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কুয়াশাঘেরা ওইদিন সুবেহ সাদেক শুরু হয় পাকিস্তানিদের গুলির শব্দে। দুটি নদীর পাড়ে গানবোট নিয়ে কয়েক প্লাটুন পাক সেনা হামলে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলে। ২২টি গ্রাম থেকে নিরীহ ১৩৯ জনকে ধরে এনে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীনগর গ্রামে স্তুপ করে রাখা হয়। কারও কারও লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে। ২২টি গ্রামের বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী।

বক্তাবলীর সাবেক ইউপি সদস্য আবদুর রহিম জানান, বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে এসে থাকতেন। এ খবর রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের জানিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে এসে ২৯ নভেম্বর তারা এখানে হামলা চালায়।

তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন রিজভী জানান, তারা মুজিব বাহিনীর অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষ করে বক্তাবলী ও এর আশপাশ গ্রামে অবস্থান নেন। ওই সময়ে বক্তাবলী গ্রামে এক থেকে দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। নদী বেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় এলাকাটিকে নিরাপদ মনে করতো মুক্তিযোদ্ধারা। বক্তাবলীতে অবস্থান করেই মূলত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করার পরিকল্পনা করতো। ওই এলাকাতে তখন কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম, বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর আজহার হোসেন, আবদুর রব, মাহফুজুর রহমান, স ম নুরুল ইসলামসহ আরো অনেকে তখন বক্তাবলীতে অবস্থান করতেন।

ঘটনার দিন তথা ২৯ই নভেম্বর ছিল প্রচণ্ড শীত। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল পুরো এলাকা। নদী বেষ্টিত হওয়ায় কুয়াশা ছিল অনেক বেশি। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পাক বাহিনী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন বক্তাবলীতে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। পরে তারা একত্রে পাক বাহিনীর সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ চালায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাক হানাদাররা পিছু হঠতে শুরু করে। এ সময় তারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর পরামর্শে ১৩৯ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইন ধরিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। চলে যাওয়ার সময় পাক হানাদার বাহিনী একে একে বক্তাবলী পরগনার ২২ গ্রামে আগুন দেয়।

এদিকে বক্তাবলী দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ নিহতদের পরিবারের পক্ষ হতে নানা ধরনের কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

add-content

আরও খবর

পঠিত