তিতাসের ৮ জনের নামে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার নির্দেশ

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) জমা দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত। একই সঙ্গে অভিযুক্ত তিতাস গ্যাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

২৫ই এপ্রিল রবিবার গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেন নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, মসজিদ কমিটির সভাপতি সহ ২৯ জনের নামে সিআইডির দাখিল করা অভিযোগপত্র গত ১১ই মার্চ নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাউসার আলমের আদালত আমলে নিয়ে মামলাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে অভিযুক্ত তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মামলা শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ এপ্রিল।

এ বিষয়ে সিআইডি নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, আদালত অভিযোগপত্র আমলে নিয়েছেন এবং অভিযুক্ত তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।

আদালতের আদেশ অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলে অনুমোদন চেয়ে তাগিদপত্র দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজের পরবর্তী সময়ে গ্যাস বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটে। এই অগ্নিকাণ্ডে মসজিদে ইবাদাতরত ৩৭ জন মুসল্লী ও ১ জন পথচারী অগ্নিদ্বগ্ধ হয়। তার মধ্যে ৩৪ জন মুসল্লী ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর অধীন শেখ হাসিনা বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারী বিভাগে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ৪ জন এখনও নিজ নিজ বাড়িতে চিকিৎসারত আছেন। অগ্নিকাণ্ডে মসজিদের এসি, থাই গ্লাস সহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আগুনে পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, জেলা প্রশাসন, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, সিটি করপোরেশন পৃথক পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, মসজিদ কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেন।

পরবর্তী সময়ে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডি। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি গণশুনানিতে ৪৩ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন। বিস্ফোরণের ঘটনায় তিতাস গ্যাস মসজিদের উত্তর পাশের সড়কের মাটি খুঁড়ে পরিত্যক্ত পাইপলাইনে ছয়টি ছিদ্র দেখতে পান। ছিদ্র পাওয়ার পরদিন ৭ সেপ্টেম্বর তিতাস গ্যাস ফতুল্লা অঞ্চলের চার কর্মকর্তাসহ আটজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন ও তিতাস গ্যাসের তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি মসজিদে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় তিতাসের গ্যাসের লিকেজ, বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা বৈদু্যুতিক ত্রুটি, মসজিদ কমিটির অবহেলাসহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা চিহ্নিত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

মসজিদে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুরসহ ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত তিতাস গ্যাসের আটজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে উল্লেখ করে সিআইডি।

সিআইডির তদন্তে অভিযুক্তরা হলেন- মসজিদের পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুর মিয়া (৬০), মো. সামসুদ্দিন সরদার (৬০), মো. শামসু সরদার (৫৭), মো. শওকত আলী (৫০), মো. অসিম উদ্দিন (৫০), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪০), মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল (৪৫), মো. নাঈম সরদার (২৭), মো. তানভীর আহমেদ (৪৫), মো. আল আমিন (৩৫), মো. আলমগীর সিকদার (৩৫), মাওলানা মো. আল আমিন (৪৫), মো. সিরাজ হাওলাদার (৫৫), মো. নেওয়াজ মিয়া (৫৫), মো. নাজির হোসেন (৫৬), মো. আবুল কাশেম (৪৫), আব্দুল মালেক (৫৫), মো. মনিরুল (৫৫), মো. স্বপন মিয়া (৩৮), মো. আসলাম আলী (৪২), আলী তাজম মিল্কী (৫৫), মো. কাইয়ুম (৩৮), মো. মামুন মিয়া (৩৮), মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. বশির আহমেদ হৃদয় (২৮), মো. রিমেল (৩২), মো. আরিফুর রহমান (৩০), মো. মোবারক হোসেন (৪০) ও রায়হানুল ইসলাম (৩৬)।

অভিযোগ পত্রে সিআইডি উল্লেখ করেন, মামলাটি জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ঘটনার ৫ দিন পর অর্থাৎ ১০ সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেয় সিআইডি। তদন্তকালে সিআইডি ক্রাইমসিনসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, বস্তুগত আলামত সংগ্রহ করে ও অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উদঘাটন করে। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দায়িত্বে অবহেলার জন্য তিতাস গ্যাস টিএন্ডডি কোঃ লিঃ এর ফতুল্লা জোনের দায়িত্বরত ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ১৯ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে সিআইডি।

তারা হলেন, তিতাস গ্যাস ফতুল্লা আঞ্চলিক অফিসের বরখাস্ত হওয়া ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (৪২), উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান রাব্বী (৩৪), সহকারী প্রকৌশলী মানিক মিয়া (৩৩), সহকারী প্রকৌশলী এস এম হাসান শাহরিয়ার (৩২), সিনিয়র সুপারভাইজার মনিবুর রহমান চৌধুরী (৫৬), সিনিয়র উন্নয়নকারী মো. আইউব আলী (৫৮), সাহায্যকারী হানিফ মিয়া (৪৮) ও কর্মচারী ইসমাইল প্রধান (৪৯)। তাদের দুদিনের রিমান্ড শেষে ২১ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করা হলে তারা জামিনে কারামুক্ত হন।

পরবর্তী সময়ে তিতাস গ্যাসের চার কর্মকর্তাসহ আটজনকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। ডিপিডিসির ১ জন মিটার রিডার ও ২ জন ইলেকট্রিশিয়ানসহ মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ইলেকট্রিশিয়ান মোবারক ও রায়হান অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। তদন্তে মসজিদ কমিটির বিরুদ্ধে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার প্রমান পাওয়ায় মসজিদ কমিটির সভাপতি আব্দুল গফুরকেও গ্রেফতার করা হয়।

সিআইডি’র তদন্তে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ উদ্ঘাটন করা হয়। ঘটনার পূর্ব হতে প্রায় তিন মাস যাবৎ মসজিদের পাশে তিতাস গ্যাস পাইপের লিকেজ হতে গ্যাস বের হয়ে মসজিদের অভ্যন্তরে জমা হতে থাকে। বাধাহীনভাবে গ্যাস উদগিরণ হয়ে মসজিদ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। ঘটনার ৭-৮ দিন পূর্ব হতে গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে মুসল্লীরা বিষয়টি মসজিদ কমিটিকে জানায়। কিন্তু মসজিদ কমিটি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

ঘটনার দিন এশার নামাজের সময় বৈধ বিদ্যুৎ লাইন চলে গেলে ম্যানুয়াল চেঞ্জওভারের মাধ্যমে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হলে বিদ্যুতের স্পার্ক হয়। তখন বিদ্যুতের স্পার্ক ও মসজিদে জমে থাকা গ্যাসের সমন্বয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। তাৎক্ষনিক স্থানীয় লোকজন অগ্নিদগ্ধ মুসল্লীদের অটোরিকশা ও রিকশাযোগে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিলে সেখানে বার্ণ ইউনিট না থাকায় দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ণ ইউনিটে প্রেরণ করে। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় অগ্নিদ্বগ্ধ ৩৪ জন মুসল্লী মৃত্যুবরণ করেন এবং ৪ জন মুসল্লি চিকিৎসা শেষে বর্তমানে বাড়িতে আছেন। মসজিদ কমিটির সঠিকভাবে মসজিদ পরিচালনায় অবহেলা, অ-ব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা, সঠিকভাবে রক্ষনাবেক্ষন না করা, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ঝুঁকিপূর্ণভাবে লাগানো, গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাৎক্ষনিক কোন ব্যবস্থা না নেয়া ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোঃ লিঃ (ডিপিডিসি) এর মিটার রিডিং কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণভাবে মসজিদের অভ্যন্তরে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোঃ লিঃ এর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ঘটনাস্থল এলাকার তিতাস গ্যাসের দায়িত্বে থেকে দায়িত্বে অবহেলা, গ্যাস লাইনের সঠিকভাবে তদারকি না করা, পাইপের লিকেজ মেরামত না করা, গ্যাস লাইন ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপন বা স্থানান্তর করার কারণে ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়ে ৩৪ জন মুসল্লী অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত ও ৪ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে সিআইডি’র তদন্তে সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া গেছে।

তিতাস গ্যাস নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক গোলাম ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতের আদেশের বিষয়টি তার জানা নেই। সিআইডি এমন কোনো আবেদন করেছে কি না, সেটিও তিনি জানাতে পারেননি।

add-content

আরও খবর

পঠিত