সাংবাদিক জিসানের জামিন নামঞ্জুর

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তারে বাধা ও পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার তরুণ সাংবাদিক জান্নাতুল ফেরদৌস জিসানের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছে আদালত।

বুধবার (১৪ মে) দুপুরে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হায়দার আলী শুনানি শেষে এ আদেশ দেন বলে জানান আদালত পুলিশের পরিদর্শক কাইউম খান।

একই মামলায় গ্রেপ্তার জিসানের বাবা মো. হানিফ (৫০) ও চাচা জনপ্রিয় অনলাইন কনটেন্ট ক্রিয়েটর শওকত মিথুনের (৩৬) জামিন আবেদনও আদালত নাকচ করেছে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।

এর আগে গত সোমবার দিবাগত রাতে নগরীর শহীদনগর এলাকার নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন জান্নাতুল ফেরদৌস জিসান (২১)। তিনি স্থানীয় অনলাইন পোর্টাল প্রেস নারায়ণগঞ্জ’র সংবাদদাতা এবং প্রথম আলো পত্রিকার পাঠক সংগঠন বন্ধুসভার পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক।

কিশোর ম্যাগাজিন কিশোর আলো তেও কন্ট্রিবিউটর হিসেবে জিসান লেখালেখি করে বলে জানান তার পরিবারের সদস্যরা।

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া জিসান জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আন্দোলনের সময় পায়ে আঘাতপ্রাপ্তও হন জিসান।

তাদের পক্ষে আদালতে জামিন শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট আওলাদ হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম।

আওলাদ হোসেন বলেন, “আমরা আদালতে জামিনের প্রার্থনা করেছিলাম। জিসান একজন সাংবাদিক এবং গত বছরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। মিথুনের ভিডিও ভøগগুলো আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এই আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নাই।”

এই মামলায় ৫২ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫০-২০০ জনকে আজ্ঞাস আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আমার আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো পার্ট-প্লে নাই, ৩২৩ ধারারও স্পেসেফিক কোনো অভিযোগ নাই। পুলিশ যে ধারাটি দিয়েছে তাদের গুরুতর আহতের কোনো সার্টিফিকেটও নাই। তাছাড়া, সিসি ক্যামেরার কোনো ফুটেজ বা আমাদের সেখানে উপস্থিত বা সম্পৃক্ততার কোনো এভিডেন্স রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উপস্থিত করতে পারেন নাই। তাদের বিরুদ্ধে গড় অভিযোগ তারা আওয়ামী লীগের কর্মী। অথচ তারা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তারা মাঠে ছিল, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু আদালত বিষয়গুলো জামিনের বিষয়ে বিবেচনায় নেয় নাই’, যোগ করেন তিনি।

সবকিছু আদালতে জানানোর পরও ন্যায়বিচার পাননি উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, “শুধু তাই নয়, জিসানের ২১ তারিখে ভর্তি পরীক্ষা, সেই পরীক্ষার বিষয়েও উপস্থাপন করেছি। এবং এই মামলার একজন আসামি অন্তঃসত্ত্বা নারী, তার বাড়ি শহীদনগর। যার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে কয়েক মাইল দূরে। তার বিষয়েও বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করেছি। ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ আদালতে উপস্থাপন করেছি। কিন্তু আদালত এসব বিবেচনায় নেয় নাই। আমরা ন্যায়বিচার পাই নাই।

সাংবাদিক জিসানকে এ ধরনের ‘মিথ্যা মামলায়’ সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ‘হস্তক্ষেপ’ করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সাংবাদিক নেতা ও প্রবীণ আইনজীবী মাহবুবুর রহমান মাসুম।

তিনি বলেন, “আদালতে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এইখানে পিও মানে ঘটনাস্থল দুইটা। মামলা হবার কথা ছিল দুইটা। কিন্তু সেখানে দুইটা ঘটনাস্থলকে একসাথে করে পুলিশ মামলা করেছে। ওইদিন কারা পুলিশের গাড়িতে ঢিল ছুড়েছে, লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছে তা শহরবাসী দেখেছে, এবং তা পত্র-পত্রিকায় এসেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এইটাও আমরা কোর্টকে বলেছি। গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্ব পালন করতে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। ওইদিন তো ঘটনাস্থলে অসংখ্য গণমাধ্যমকর্মীরা ছিল। তাহলে জিসান কেন এই মামলার আসামি হবে? এই ঘটনায় তার আসামি হওয়াটা অবান্তর, এইটাও আদালতকে বলেছি। জিসানকে ভিক্টিম করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে মনে করি।”

এ আইনজীবী বলেন, “এইটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ঘটনা। কারণ, পুলিশ কোথাও অবরুদ্ধ হয়ে সেখানে আপ্যায়িত হয় না। তারপরও মামলা দিয়েছে, আমরা আইনি লড়াই লড়ছি। জিসানের বিরুদ্ধে যে মামলা দিয়েছে, তাকে আমরা মনে করি, গণমাধ্যমের উপরে নগ্ন হস্তক্ষেপ। যেখানে সরকার, সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এবং নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, কোনো মিথ্যা মামলায় সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু সাংবাদিক তো গ্রেপ্তার হলো, নির্দেশনার ব্যত্যয় তো ঘটলো। আমরা ৫ আগস্টের পরে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছি, সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন তো ফিকে হয়ে আসছে। এইভাবে পুলিশ যদি তার অবস্থান পরিবর্তন না করে তাহলে তো মুশকিল। ঘটনাস্থলে যারা ছিল না, এমনকি একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা যার বাসা কয়েক মাইল দূরে, তাকেও আসামি করা হয়েছে। এই সমস্ত ঘটনা না থামালে আগস্ট বিপ্লবও বিতর্কিত হবে।”

গত ৮ মে রাতে আইভীকে গ্রেপ্তার করতে নগরীর দেওভোগে তার পৈতৃক বাড়ি ‘চুনকা কুটিরে’ গেলে তার সমর্থক ও স্থানীয় এলাকাবাসী বাধা দেন। আইভীও ‘রাতের আঁধারে’ কোথাও যাবেন না বলে জানান। পরে সকালে স্বেচ্ছায় গাড়িতে ওঠেন তিনি। তাকে নিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কালিরবাজার মোড়ে পুলিশের গাড়িবহরে হামলা করা হয়।

এতে পুলিশসহ আইভীর বেশ কয়েকজন সমর্থক আহত হন।

প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সাংবাদিক জানান, মহানগর যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা আইভীকে বহন করা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়েন। ওই সময় ককটেল বিস্ফোরণও ঘটে। ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিওতে হামলাকারীদের মধ্যে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের একাধিক নেতা-কর্মীকে দেখা যায়। পরে তারা বঙ্গবন্ধু সড়কে ‘আওয়ামী লীগ ও আইভীর’ বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মিছিলও করেন।

পরে গত ১২ মে রাতে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গ্রেপ্তারে বাধা ও পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে ৫২ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও।

পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন মৃধা বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন বলে জানান এ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জামাল উদ্দিন। এ মামলায় অজ্ঞাত আরও ১৫০-২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা জামাল বলেন, মামলার এজাহারনামীয় তিনজন আসামিকে মামলার রাতেই গ্রেপ্তার করা হয়।

add-content

আরও খবর

পঠিত