নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে, বিশেষ ক্লাশের নামে খোদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই চলছে কোচিং বাণিজ্য! শহরের অনেক নামি-দামি স্কুল-কলেজে বিশেষ ক্লাসের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এবং আদায় হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এই বিশেষ ক্লাসে অংশ না নিলেও ফি দিতে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থীদের-অভিভাবকদের, “অন্যথায় আটকে দেওয়া হয় ক্লাস, পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলাফল।” অভিবাভকদের আপত্তি সত্তেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে এই ক্লাস বাধ্যতামূলক। করা হচ্ছে সরকারি নীতিমালার অপ-ব্যাখ্যা।
শহরের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ মর্গ্যান স্কুল এন্ড কলেজে বিশেষ ক্লাস নামক এই শিক্ষা বাণিজ্যের কারণে ঘটেছে এক ন্যক্কারজনক ঘটনা! আটকে দেয়া হয়েছে কোচিং না করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল। ভূক্তভোগী এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, আজ স্কুলে আমার সহপাঠীদের হাতে ১ম সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল (রেজাল্ট কার্ড) দিয়েছে, কিন্তু আমরা যারা কোচিং করিনি তাদেরকে পরীক্ষার ফলাফল দেয় নি। লায়লা আপা (স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক) বলে দিয়েছে যারা কোচিং করে নি তাদের ফলাফল দেয়া হবে না। তবে যে সকল স্টুডেন্ট গত চার মাসের কোচিং ফি বাবদ ২০০০ টাকা দিবে তার ফলাফল দেয়া হবে। অন্যথায় কোনভাবেই ফলাফল দেয়া হবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বিশেষ ক্লাসের নামে কোচিং করিয়ে সহ¯্রাধিকের বেশী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিমাসে পাঁচ লক্ষাধিকের বেশী টাকা আদায়ের করছে মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালা পর্ষদের সদস্যরা। এই স্কুল এন্ড কলেজে ৫ম, ৮ম ও ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরকে বাধ্যতামূলক ক্লাসের আগে বিশেষ ক্লাস করতে হয়। আর এ জন্য প্রতিমাসেই ফি বাবদ দিতে হয় অতিরিক্ত পাচঁশত টাকা (৫০০)। এখানে কোন শিক্ষার্থীর বা তার অভিভাবকের কোন আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয় বলেও অভিযোগ করেন অনেক শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অভিভাবকদের অভিযোগ, বিদ্যালয়টির ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত নিয়মিত পাঠদান ক্লাশের আগে পরে কোচিং (বিশেষ ক্লাশ) এর নামে প্রতিজন ছাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা হারে এসব টাকা আদায় করা হয়। যদিও স্কুলে কোচিং ক্লাস করানোর ব্যাপারে অভিভাবকদের ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, তারপরও সরকারি সেই নির্দেশনা অমান্য করেই এখানে চলছে কোচিং বাণিজ্য।
এ নিয়ে সন্তানদের নানা সমস্যার কথা চিন্তা করে ভূক্তভোগী ছাত্রী ও অভিভাবকরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন একাধিক অভিভাবক। পেশায় চাকুরীজীবি, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজন অভিভাবকের মেয়ে পড়ালেখা করে মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে। তিনি মেয়েকে স্কুলের কোচিং ক্লাসে পড়াতে রাজী নন। বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর অভিভাবকের উপর মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। স্কুলে মেয়ের নানা সমস্যা হওয়ার কথা চিন্তা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ দিতে পারেননি বলে জানান ভূক্তভোগী আরেক অভিভাবক।
তিনি বলেন, আমার মেয়ে মর্গ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। কোচিং ক্লাসে পড়তে অনীহা প্রকাশ করায় প্রথমে বলা হয় পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। পরবর্তীতে কোচিং ক্লাস না করিয়েও স্কুল ও পরিচালনা পর্ষদের অবৈধ দাবির কাছে হার মেনে চার মাসের কোচিং ফি বাবদ ২০০০ টাকা দিয়ে তারপর পরীক্ষার প্রবেশ পত্র সংগ্রহ করি। স্কুলে মেয়ের নানা অসুবিধার হওয়ার কথা চিন্তা করে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করিনি। এক প্রকার বাধ্য হয়ে মেয়েকে স্কুলের কোচিং ক্লাসে পড়াতে হচ্ছে।
শহরের এক মুদির দোকানী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্কুলটিতে তার এক মেয়ে পড়ে। কোচিং ক্লাশ করতে অনীহা প্রকাশ করায় মেয়ের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। ঐ মুদি দোকানি বলেন, ‘আমি সামান্য মুদির দোকান থেকে আয়-রোজগার দিয়ে সংসার চালাই। আমার এক ভাইপো বাড়ীতে মেয়েটিকে পড়ায়। মেয়েটি স্কুল কর্তৃপক্ষকে কোচিং ক্লাস করতে অনীহা জানালে তার উপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। পরে মেয়েটি বাসায় এসে কান্নাকাটি শুরু করলে বাধ্য হয়ে কোচিং ক্লাসে পাঠাতে বাধ্য হই।
এরপূর্বে গত বৃহস্পতিবার থেকে শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার খাতা দেয়া হয়। কিন্তু যারা কোচিং করেনি তাদেরকে কোন পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য পরীক্ষার খাতা দেয়া হয় নি এমনকি প্রাপ্ত নম্বরপত্র মুখেও বলা হয়নি। অভিভাবকদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত শনিবার দুপুরে কথা বলতে ফোন দিলে, সরেজমিনে আসতে বলেন মর্গ্যান বালিকা স্কুল এন্ড কলেজে অধ্যক্ষ অশোক তরু। সরেজমিনে উপস্থিত হলে তিনি বিশেষ ক্লাসের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, বিশেষ ক্লাস করতেই হবে। এটা স্কুলের রুলস। সরকারী সিদ্ধান্ত তো বিশেষ ক্লাসে যার পড়ার ইচ্ছা নেই সে পড়বে না, তবে কেন তাদেরকে জোর করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তর তার আগেই দেন সেখানে উপস্থিত থাকা বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আহসান হাবিব।
যিনি গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্যপদে নির্বাচন করে শুন্য ভোট পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, সরকারী সিদ্ধান্ত না তো কি হয়েছে? এটা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত, সবাইকে তা মানতে হবে। তিনি এও বলেন, বিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার সর্বে সর্বা হলেন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। যিনি একই সাথে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও। আহসান হাবিব বলেন, চেয়ারম্যান দেশের বাইরে আছেন, ১৫ তারিখ (আজ) দেশে আসবেন তারপর যারা কোচিং করে নি তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তবে সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি ধারনা দিয়ে বলেন, হতে পারে যারা গত চারমাস কোচিং করে নি তাদের গত চার মাসের ফি মওকুফ করে দেয়া হবে। কিন্তু এই মাস অর্থ্যাৎ মে মাস থেকে কোচিং করতেই হবে। এটা বাধ্যতামুলক।
তবে এ ব্যপারে অধ্যক্ষ অশোক স্যারকে একাধিকবার তার মুঠোফোনে ব্যবহৃত নাম্বারে কল করে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেনি।
আহসান হাবিবের কথা মতো আজ ১৫ মে আনোয়ার হোসেনের দেশে আসার পর ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আলোচনা করার কথা থাকলেও আজ যারা কোচিং করে নি তাদেরকে পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হয় নি।
এবিষয়ে জানতে চেয়ে আহসান হাবিবের সাথে যোগাযোগ করে বলা হয়, আমরা কয়েকজন সাংবাদিক গত কয়েকদিন আগে মর্গ্যান স্কুলে এসেছিলাম আপনি বলেছিলেন ১৫ তারিখে চেয়ারম্যান আসলে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্ত আজ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল দিলেন, তবে যারা কোচিং করেন নি তাদের টা আটকে রেখেছেন কেন ? এমন প্রশ্নের উত্তরে আহসান হাবিব বলেন, তোমরা না গতকাল অফিসে এসে গেলা- এতো পাগল হইছো কেন? এতো পাগল হইলে হয় ? তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে বলা হলো আমরা গত শনিবার আপনার বিদ্যালয়ে এসেছিলাম। তখন তিনি বলেন, চেয়ারম্যান সর্বেসর্বা। তিনি দেশে এসেছে তার সাথে যোগাযোগ করো।
এবিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, যারা কোচিং করে নাই তাদের পরীক্ষার ফলাফল সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়তো দিয়ে দেয়া হবে। এছাড়াও যারা কোচিং এর টাকা পরিশোধ করে নি তারা কেন করে নি এবিষয়ে আলোচনা হবে। তবে কোচিং করতে হবে এটা স্কুলের সিদ্ধান্ত। সরকারী নির্দেশনায় রয়েছে কোচিং করা না করা যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছা এটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বলেন, সরকারী সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, তবে স্কুলেরও তো কিছু সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে পরীক্ষার ফলাফল আটক না রেখে শিক্ষার্থীদের কাছে দিয়ে পরে কি ব্যবস্থা নেয়া যেত না এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এটাতো সাময়িক ভাবে আটক রাখা হয়েছে। স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা মানতে তাদের ফলাফল দেয়া উচিত নয়। কেন তারা স্কুলের নিয়ম ভাঙ্গবে? তবে অভিভাবকদের অনুরোধেই বিশেষ ক্লাস (কোচিং) চালু করা হয়েছিল এবং অভিভাবকরা যদি মনে করেন বিশেষ ক্লাসের (কোচিং) দরকার নেই তাহলে বিশেষ ক্লাস (কোচিং) বন্ধ করে দেয়া হবে বলে তিনি জানান।