নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : নারায়ণগঞ্জ শহর ও বন্দরকে সংযুক্ত করতে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর প্রস্তাবিত কদমরসুল সেতুটি শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় নির্মাণের সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও শেষ মুহুর্তে এসে এতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতসহ চারটি রাজনৈতিক দল। দলগুলোর নেতারা সেতুটি নবীগঞ্জ-হাজীগঞ্জ ঘাট এলাকায় নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
সোমবার (২৬ মে) বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক এএইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে বৈঠকে এ দাবি জানান তারা। একইসাথে শহরের যানজট, জলাবদ্ধতা, পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এসব সংকট সমাধানে সমন্বিত পদক্ষেপেরও দাবি জানান তারা।
সিটি প্রশাসকের সঙ্গে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবদুল জব্বার, সাবেক আমীর মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসাইন, মহানগর ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ, মহানগর খেলাফত মজলিসের সভাপতি কবির হোসেন।
সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে বন্দরের একরামপুর এলাকা থেকে শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কদমরসুল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন তৎকালীন সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। পরে একনেক সভায় এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। নানা জটিলতা পেরিয়ে সম্প্রতি এ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ হয়েছে। সেতু নির্মাণের তত্ত্বাবধানে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ।
তবে, সেতুটির স্থান পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে বিএনপিসহ চারটি দলের নেতাদের দাবি, শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় সেতুটি নির্মিত হলে যানজট বৃদ্ধি পাবে। এতে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। সেতুটি বন্দরের নবীগঞ্জ থেকে শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় নির্মিত হলে কাক্সিক্ষত সুফল পাবে মানুষ।
যদিও সিটি কর্পোরেশন বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের এ পর্যায়ে এসে স্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সিটি কর্পোরেশন রাখে না। প্রকল্পটি একনেক সভায় পাস হওয়া, ফলে এর সিদ্ধান্ত নেবে সরকার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, “জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর নারায়ণগঞ্জের মানুষ সব ধরনের দুর্ভোগ নিরসন থেকে মুক্তির আশা করেছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে রেখে যাওয়া জঞ্জাল দ্রুতই সমাপ্ত করা সম্ভব নয়। ফ্যাসিস্টের দোসররা সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব বাধ পেরিয়ে কীভাবে নাগরিক সংকট সমাধান করা যায় সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সরকারের যাতে কোনো বদনাম না হয়।”
রাস্তার খোড়াখুড়ির কাজ দ্রুত শেষ করে জনদুর্ভোগ কমানোর দাবিও জানান তিনি। কিছু ঠিকাদার ‘ধীরগতিতে’ কাজ করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সংস্কার কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে না পারলে আসন্ন প্রবল বর্ষণে শহরে ‘জলযট’ তৈরি হবারও শঙ্কা প্রকাশ করেন এ বিএনপি নেতা।
একইসাথে তিনি নগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহও নিশ্চিতেরও দাবি জানান।
কদমরসুল সেতু ৫ নম্বর ঘাট দিয়ে হলে যানজট ও জনদুর্ভোগ বাড়বে বলে মন্তব্য করেন আবু আল ইউসুফ খান টিপু। তিনি বলেন, এ এলাকায় (একরামপুর-পাঁচ নম্বর ঘাট) কদমরসুল ব্রিজ হলে যানজট ও জনদুর্ভোগ বাড়বে। সেতুটি ৫ নম্বর ঘাট দিয়ে না হয়ে নবীগঞ্জ-হাজীগঞ্জ দিয়ে হলে মানুষের উপকার হবে। তিনি রেল ও বাস টার্মিনাল শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ারও দাবি জানান।
শহরে চলমান সংস্কার কাজের কারণে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন টিপু। এসব সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক আশ্বাস দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। প্রশাসকের সঙ্গে চাঁদাবাজি, ভূমি দখল ও হকার সমস্যা সমাধানের বিষয়েও আলাপ হয়েছে বলে জানান এ বিএনপি নেতা।
কদমরসুল সেতুর স্থান পরিবর্তনের দাবিতে জোর দিয়ে মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর আবদুল জব্বার বলেন, “এখনও সরকারি ব্যক্তিদের কাছে দায়সারা কিছু বক্তব্য শুনি। তারা বলেন, এটি একনেকে পাস হয়ে গেছে, আমাদের কী করার আছে! এখানে আপনাকে জনগণের খেদমতের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের উদ্বেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি আগে দেখতে হবে। এমন কিছু করা যাবে না যাতে জনদুর্ভোগ আরও বাড়ে।”
প্রয়োজনে কদমরসুল সেতু প্রকল্প ‘রিভাইজ’ করারও পরামর্শ দেন তিনি।
যানজট সমস্যা সমাধানে হকার পুনর্বাসন জরুরি বলে মনে করেন জামায়াতের সাবেক আমীর মঈনুদ্দিন আহমাদ। এছাড়া বাস টার্মিনাল শহরের বাইরে নিয়ে চাষাঢ়া থেকে শহরের ভেতরে রেলসেবা ‘উড়াল কিংবা পাতাল’ পদ্ধতিতে করার দাবিও জানান তিনি।
একইসঙ্গে কদমরসুল সেতুর স্থান পরিবর্তনেরও দাবি জানান জামায়াতের এ নেতা। তার ভাষ্য, “সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা বিশেষভাবে ব্রিজটা নিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষন করেছি। এই ব্রিজটা হওয়ার কথা অনেক আগেই। এই ব্রিজের জায়গা উদ্বোধন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সেই ব্রিজটা সেখানে না করে সাবেক মেয়র ব্রিজটা করার পরিকল্পনা করেছেন মাছ বাজারের (৫ নম্বর ঘাট) জায়গা দিয়ে। এই ব্রিজটা মানুষের জন্য এমন এক দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে যে, এইটা হলে মানুষ শহর থেকে বের হওয়ার রাস্তাঘাট পাবে না। প্রশাসককে বলেছি, এই ব্রিজ নারায়ণগঞ্জের মানুষ হতে দিবে না।”
হাজীগঞ্জ-নবীগঞ্জ ঘাটে ব্রিজটা হতে হবে। আমরা এইটা সিরিয়াসলি বলে দিয়েছি। নাহলে মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে, মানুষ বসবাস করতে পারবে না, যোগ করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, “আজকে নারায়ণগঞ্জে একটি ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত ছিল, বিশেষ করে ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে আমরা যেসব রাজনৈতিক দল মাঠে ছিলাম, তারা সবাই সিটি কর্পোরেশনে এসেছিলাম। আমরা স্বেচ্ছায় এসেছি এবং প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। এককভাবে আমরা আগেও এখানে এসেছি, কথা বলেছি কিন্তু সম্মিলিতভাবে কথা বললে উপকার হবে, সেই আশায় আমরা বিভিন্ন দাবি জানিয়েছি।”
তিনিও সিটি কর্পোরেশনের কিছু কার্যক্রম ‘ইচ্চে করে ধীরগতিতে’ চলছে বলে অভিযোগ করেন।
সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৭৫টি মসজিদের কর্মকর্তা (ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেম) নতুন করে নিয়োগের দাবিও জানান।
নগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির দাবি জানান মহানগর খেলাফত মজলিসের সভাপতি কবির হোসেন।
তিনিও দাবি করেন, কদমরসুল সেতুটি ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দিয়ে হলে মানুষ ‘প্রকৃত সেবা’ বঞ্চিত হবেন।
জানতে চাইলে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক এএইচ কামরুজ্জামান প্রেস নারায়ণগঞ্জকে বলেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা এসে জলাবদ্ধতা, হকার, যানজট সমস্যা নিয়ে বিস্তৃত কথা বলেছেন। এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। জনজীবন সহজ করতে আমাদের চেষ্টা রয়েছে।
কদমরসুল সেতুর স্থান পরিবর্তনের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রকল্প অ্যাপ্রুভালের একটা প্রসেস আছে। একনেকে অনুমোদন হওয়ার পর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিষয় আসে। এই ধরনের প্রকল্পে প্রকল্পক্ষেত্র পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে যায়, এখানে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয় থাকে। আমরা বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে এ দাবি প্রসঙ্গে জানাতে পারি কিন্তু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তারা। জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে এই বিষয়ে হয়তো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।