নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : আলোচিত সাতখুন মামলার চতুর্থ বছর পূর্ণ হলো আজ শুক্রবার। প্রতিক হয়ে ওঠা আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনী র্যাপিড একশন বেটেলিয়ান (র্যাব) এর গায়েও তীলক লাগে বিপথে চলে যাওয়া কিছু কর্মকর্তার কারণে। যারা এ হত্যাকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশের ঘৃণ্য ও আলোচিত হত্যাকান্ডের সূত্রপাত্র ঘটে এ দিনে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম এবং আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার ড্রাইভারকে অপহরণ করা হয়। এর তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
আলোচিত সাতখুন নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ে জামাতা বিজয় কুমার পাল নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি দুটি মামলা দায়ের করেন।
লোমহর্ষক সাতখুন হত্যাকান্ডের মূলক নায়ক সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও নাসিকের ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরহোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে টানটান উত্তেজনায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২৬ জনের মৃত্যুদন্ড ও বাকি ৯জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করেন।
সাতখুন হত্যাকান্ডের বিচারে ২০১৭ সালের বছরের ২২ আগস্ট মঙ্গলবার আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদন্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। রায়ে যে ২৬ জনের মধ্যে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত তাদের মধ্যে প্রদান চার আসামী সহ ১৫জনের মৃতুদন্ড তথা ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে হাইকোর্ট। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বাকি ১১জনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দন্ড দেওয়া হয়েছে।
সাতখুনে নিহতদের স্বজনরা আলোচিত এ হত্যাকান্ডের রায় দ্রুত কার্যকরের আশায় এখনো বুক বেধে আছেন।
সাত খুনে নিহত জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নুপুর বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই এ সরকারের আমলেই সাত খুনের মামলা আসামীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি। যারা আমার স্বামীসহ সাতজনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।
নজরুলের বন্ধু নিহত স্বপনের ভাই রিপন বলেন, সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে যা ভেবেছিলাম বাস্তবে আমরা হতাশ হয়েছি। কারো কাছ থেকেই কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।
রায় কার্যকরের ব্যাপারে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, এই রায় নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তা এবং অন্ধকারের মধ্যে আছি। আদৌ কি এই রায় কার্যকর হবে ? নাকি এইভাবেই আমরা অন্ধকারের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকব?
তিনি বলেন, ভাইকে হত্যার পর ভাইয়ের এবং আমার নিজের ব্যবসা বানিজ্য সব জোর করে দখল করে নিয়েছে নূর হোসেন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। নিজে এখন ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। তার মধ্যে রয়েছে নানা ধরণের হুমকি ধামকি। সব সময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকি, কোন দিন যেন আমাদেরকেও মেরে ফেলে।
স্বপনের খুনের খবর শুনে অন্ধ হয়ে যান তার বৃদ্ধ বাবা। চোখে কিছুউ দেখেন না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে ছেলের খুনীদের বিচার দেথে যেতে পারলে আত্মায় শান্তি নিয়ে মরতে পারব। ছেলের আত্মাও শান্তি পাবে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।
সাত খুনে নিহত তাজুল ইসলামের পিতা আবুল খায়ের বলেন, সাত খুন মামলার চার বছর শেষ হয়েছে। এ চার বছরে হাইকোর্ট পর্যন্ত এ মামলার রায়টি শেষ হয়েছে। এ রায় এখন সুপ্রীমকোর্টে গিয়েছে। আমরা কাকের মতো তাকিয়ে আছি তাদের ফাঁসির রায় হয়েছে তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হবে, যাদের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে তাদের যাবজ্জীবন সাজা হবে।
সরকার দলীয় কিছু লোক ও সরকারের কিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা যারা সাধারণ মানুষকে নিরপত্তা দিবে, আর সেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ৭ জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে। এ নির্মম নির্যাতনের বিচার কি এ দেশে হবে না ? আশা করি এ দেশেই হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই মনমানসিকতা আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি। এ মামলায় যে কয়জন আসামী এখনও পলাতক রয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানাই।
উচ্চ আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও রায় কার্যকরের ব্যাপারটি বিলম্ব হওয়ায় সংশয় প্রকাশ করেন মামলার বাদি নিহত নজরুল ইসলামের সেলিনা ইসলাম বিউটি।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন এই হত্যাকান্ডের বিচার করবেন। তিনি তার কথা রেখেছেন। তাঁর উপর আমরা কৃতজ্ঞ। আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট আছি। কিšুÍ রায়টি কার্যকর কবে হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ের মধ্যে আছি। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে উচ্চ আদালতের এই রায় কার্যকরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবী জানান তিনি।
মামলার রায় কার্যকরের ব্যাপারে ধীরগতির কথা উল্যেখ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বাদিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে রায়ের পর প্রধান বিচারপতি আশ্বাস দিয়েছিলেন বিষয়টি তিনি দেখবেন। কিন্তু প্রায় এক বছর হতে চলল মামলাটি ধীরগতিতে চলে গেছে। সরকারের মধ্যেও একটা অনীহা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি সুপ্রীম কোর্টেও অ্যার্টনী জেনারেলের কার্যালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দ্রুত রায় কার্যকর করে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য তিনি বিচার বিভাগ ও সরকারের প্রতি দাবী জানান তিনি।
এদিকে সাতখুন হত্যাকান্ডের ৪ বছর পূর্তিতে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি জানান, তার স্বামী নজরুল ইসলাসহ নিহত সাত জনের রুহের মাগফেরাত কামনায় আজ শুক্রবার দিনব্যাপী কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়াও এতিমদের মাঝে রান্না করা খাবারও বিতরণ করা হবে।