মেঝেতে ঘুম, বন্ধ ঘর, এভাবেই কেটেছে ৭০ দিন

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : পরিবারের উৎকন্ঠা, সহকর্মীদের উদ্বিগ্নতা সব ছাপিয়ে অবশেষে মায়ের কোলে সাংবাদিক উৎপল দাস। দীর্ঘ ২ মাস ১০ দিন পর মঙ্গলবার দিন শেষে মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তাকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু কারা তাকে ফেলে গেছে, এতদিন কোথায় রাখা হয়েছিল, কেনো তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নানা প্রশ্ন উৎপলকে নিয়ে। তবে উৎপল জানান, অপহরণকারীরা তাকে একটি টিনশেড ঘরে রেখেছিল। সেখানে কোনও খাট বা চৌকি ছিল না। ফলে মেঝেতেই ঘুমাতেই হতো। ঘরের দরজা বন্ধ থাকতো। তাই দরজার নিচ দিয়ে খাবার দিয়ে যেতো।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ শহীদুল আলম বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টায় আধুরিয়া গ্রামের শাহজালাল পেট্টোল পাম্পের সামনে কে বা কারা তাকে (উৎপল দাস) নামিয়ে দিয়ে যায়। উৎপল দাস বলেন, বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল এখান থেকে। তবে গাড়ির টিকিট পাইনি। এরপর রূপগঞ্জ পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে আসে। পুলিশ পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম গিয়ে আমাকে সিএনজি স্টেশন থেকে নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় তিন-চার ঘণ্টা একটি গাড়িতে করে ঘোরানো শেষে এখানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু আমি জানি না। আমাকে যখন এখানে (আধুরিয়া) নামিয়ে দেওয়া হয় তখন তারা আমার চোখ খুলে দিয়ে বলেছে, আমরা যখন গাড়ি টান দেবো তখন তুই চোখ খুলবি।

তিনি বলেন, আমাকে একটি টিনশেড নরমাল ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। তিন বেলা নরমাল খাবার দেওয়া হতো। সেখানে চৌকি বা খাট ছিল না। ফ্লোরের মধ্যে থাকতে হয়েছিল। ওই ঘরে এটাচ বাথরুম ছিল। সেখানে গোসল করতাম। আমার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তারা দরজার নিচ দিয়ে খাবার দিয়ে যেতো।

উৎপল দাস বলেন, আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম দিকে কিছু চড়-থাপ্পড় মারা হয়েছে। তারা আমাকে বলতো, তোর অনেক টাকা। তুই টাকা দে।

তিনি বলেন, আমাকে ধানমন্ডি স্টার কাবাবের সামনে থেকে দুপুরের দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পেছন থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার চোখ বাঁধা ছিল। কাউকে দেখতে পাইনি। অপহরণকারীদের আচরণে পেশাদারিত্ব ছিল কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিষয়টি এড়িয়ে যান উৎপল। এখন কেমন আছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি ভালো আছি, দেখলে বুঝবেন। উৎপল আরও বলেন, যারা আমাকে ধরে নিয়েছিল, তারা আমার মোবাইল নিয়ে যায়। এরপর কি হয়েছে আমি জানি না। তারা কি করেছে জানি না। তারা আমার কাছে টাকা চাইতো। আমার কাছে মোবাইল ছিল না। গত মঙ্গলবার আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে এখানে নিয়ে আসে। চোখ খুলে দেওয়ার পর আমি বুঝতে পারি এটা ভুলতা, নারায়ণগঞ্জ।

উৎপলের মা বলেন, অনেক ভালো লাগছে, অনেক শান্তি লাগছে। আমার বাবা। তুই কান্দিস না আমি ঠিক আছি।

বোন বিনিতা রাণী বলেন, দুই মাস ১০ দিন প্রতীক্ষায় থাকার পর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা খবর পাই উৎপলকে পাওয়া গেছে। তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। উৎপল জানায়, সে ভুলতার একটি জায়গায় আছে। বললো, বাড়ি ফিরবো। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। তখন আমরা বার বার তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখনও সে বলছে, গাড়ি পাচ্ছে না। আমরা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবদানে তাকে ফিরে পেয়েছি। সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ও যে পেশায় রয়েছে সেই পেশার সাংবাদিক ভাইদের। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

বিনিতা রাণী বলেন, উৎপল জানিয়েছে তাকে অপহরণের পর তার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে। কেউ কি টাকা পয়সা চেয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? এক মাস আগে আমার কাছে ফোন আসে। বলা হয়, তাকে টাঙ্গাইল পাওয়া গেছে। ওই ব্যক্তি নিজেকে এসআই রিপন তালুকদার বলে পরিচয় দেয়। সে তখন বলে, ‘উৎপলকে পাওয়া গেছে মুমূর্ষু অবস্থায়। তার চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছি। আমি আর খরচ করতে পারছি না। আপনি টাকা পাঠান। ওই ব্যক্তি আমাকে সময় দেন টাকা পাঠানোর জন্য। এভাবে আমাকে বার বার টাকা পাঠানোর জন্য বলেছে। আমি সময় নিতে নিতে তার সঙ্গে কথা বা যোগাযোগ করতে পারিনি। এক ঘণ্টা পর আমরা জানতে পারি, এটা মিথ্যা একটা খবর। এরপর থেকে কোনও খোঁজ পাইনি। আমরা তাকে পাওয়ার জন্য র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি। পরিবারের পক্ষ থেকে যখন ২৩ তারিখ থানায় জিডি করা হয় তখন ওর মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন আসে। এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরদিন আবার এক লাখ টাকা দেওয়ার জন্য ফোন আসে। তখন আমার বাবা বলেন, ‘আমি টাকা দেব, কোথায় দেব? কিভাবে দেব?’ তিনি উৎপলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর আর ওই নম্বর থেকে কোনও ফোন আসেনি। ওরা কারা তারও কোন পরিচয় দেয়নি। যারা তাকে তুলে নিয়ে গেছে তারা বলেছে, উৎপলকে ফিরে পেতে হলে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আমার বাবা টাকা দিতে চাইলেও তারা উৎপলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়নি।

উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস বলেন, আমার ছেলেকে আমি ফিরে পেয়েছি। এটাই আমার বড় আনন্দ। আপনাদের সহযোগিতা বেশি কামনা করি। সাংবাদিক মহল আমাকে সাহায্য করেছে। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। তারা তখন চেষ্টা করছেন বলে আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।

রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনর্চাজ পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম বলেন, আমি মহাসড়ক এলাকায় তদারকির দায়িত্বে ছিলাম। এ সময় এসপি সাহেব ফোন করে বলেন, সাংবাদিকরা ফোন করছেন। উৎপল দাস নামের নিখোঁজ কোনও সাংবাদিকের তথ্য জানো? আমি তখন স্যারকে বলি, আমি এই মুহূর্তে কোনও তথ্য জানি না। তিনি খোঁজ নিতে বললেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সাংবাদিকরা আমাকে ফোন করতে শুরু করেন। আমি খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। জানতে পারলাম, শাহ্জালাল ফিলিং স্টেশনে উৎপল দাস রয়েছেন। পৌঁনে ১২টার দিকে আমি সেখানে গেলে তিনি (উৎপল) আমাকে দেখে পুলিশের লোক মনে করেন। জিজ্ঞেস করি আপনি কী উৎপল দা? তখন তিনি হ্যাঁ বলে জবাব দেন। পরে তাকে বলি, আমি পুলিশ পরিদর্শক। আমার সঙ্গে চলুন। তাকে পাম্পের ভেতরে নিয়ে যাই। এ সময় তার সঙ্গে এসপি সাহেব একাধিকবার কথা বলেন। আমাকে দেখে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন।

শহীদুল ইসলাম বলেন, তাকে কে নিয়ে গেছে এমন কিছু তিনি বলতে পারেননি। আপনাকে যে নিয়ে গেছে আপনি তাকে দেখেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, আমি দেখিনি। কারা নামিয়ে দিয়ে গেছে তাও তিনি বলতে পারেননি।

ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির এই ইনর্চাজ বলেন, উনাকে (উৎপল) ধানমন্ডি থেকে অপহরণ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছে, পরে তাকে চোখ বেঁধে রেখেছে। মনে হয়, হাইয়েস গাড়ি বা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গেছে এবং ফেলে গেছে। পরে তাকে আমরা পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসি।

রাত ২টা ৪০ মিনিট ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে আসেন উৎপলের বাবা-মা বোন, বোন জামাই, ছোট ভাগিনা। এ সময় মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নায় মুষড়ে পড়েন বাবা ও বোন ভাগিনারা। দুই মাস ১০ দিন পর সন্তানকে ফেরত পেয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় সেখানে। উপস্থিত সাংবাদিকরাও কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যান মা-ছেলের এমন আবেগাপ্লুত দৃশ্য দেখে। রাত ৩টার দিকে উৎপলকে পুলিশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে। পরিবারে সদস্যরা একটি সাদা হায়েস গাড়িতে করে উৎপলকে নিয়ে নরসিংদীর রায়পুর থানার রাধানগর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহীদুল আমলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ নারায়ণগঞ্জের সীমানা পার করে নরসিদী পুলিশের প্রহরায় দিয়ে আসে।

যে ফিলিং স্টেশনের সামনে সাংবাদিক উৎপল দাসকে ফেলে যাওয়া হয়েছে; সেই শাহজালাল ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী ঝন্টু চন্দ্র বর্মন জানান, তাকে ফেলে যেতে দেখিনি। তবে ফিলিং স্টেশনের সামনে কালো ব্যাগ কাঁধে অনেক বিধ্বস্ত একজন ব্যক্তিকে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারী করতে দেখি। জানতে চাই, কোথায় যাবেন। কিন্তু তিনি মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকায় কোনও উত্তর দেননি। এভাবে সে প্রায় এক ঘণ্টা ফিলিং স্টেশনের সামনে ছিল। পরে ভুলতা ফাঁড়ি পুলিশ এসে তাকে ফিলিং স্টেশনের অফিস রুমে নিয়ে যায়। সেখানে ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্মকর্তারা ফাঁড়ি পুলিশের মোবাইলে তার সঙ্গে কথা বলেন। পরে পুলিশ গাড়িতে তুলে তাকে ভুলতা ফাঁড়িতে নিয়ে যায়।

add-content

আরও খবর

পঠিত