নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( নিজস্ব প্রতিবেদক ) : এক সময় আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। দল যখন ক্ষমতায় ছিলো না সকল কর্মসূচীতে রাজপথে থাকতেন। বিএনপি ক্ষমতাকালে মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জের শিকারও হয়েছেন। তার রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ও সাংসদ শামীম ওসমানের যে কোন কর্মসূচীর ঘোষণা আসলে তা পালন করতেন। সেই আহ্বানে ২০০১ সালের ১৬ জুন আওয়ামীলীগ অফিসে গিয়ে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে হয়েছিলেন গুরুতর আহত। নিজ ওয়ার্ডে সকল কর্মসূচী পালনে ছিলেন সক্রিয়। কিন্তু আওয়ামীলীগ নেতা সেই সৈয়দ লুৎফর রহমান এখন শয্যাশায়ী।১৫ই জুন বুধবার তার সাথে দেখা করতে গিয়ে জানা গেছে, সেই সময় চাষাঢ়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান অসুস্থ্য। যিনি এখন ব্রেন স্ট্রোক করাসহ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে বিছানা পড়ে থাকেন। তবে এখনো ক্ষত-বিক্ষত শরীরে শয়ে যাচ্ছে গ্রেনেডের স্লিন্টার বেদনা। মাঝে মাঝেই চিলিক দিয়ে উঠে সেসব স্থান। কয়েক মাস আগে শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটায় সরকারী হাসপাতলে ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে থাকতে হয়েছিল একটি বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউতে। কিন্তু প্রতিবার ১৬ জুন এলে বোমা হামলায় আহতদের মধ্যে চন্দনশীল দাদা (মহানগর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি) কর্মসূচীতে উপস্থিত থাকার জন্য খোঁজ নিলেও, স্থানীয়রা ছাড়া তেমন কোন বড় নেতারা আগের মত খোঁজ নেন না বলে জানান।এসময় দীর্ঘ সময় থেকে বোমা হামলায় সেদিনের কথা সম্পর্কে জানতে চাইলে অস্পষ্ট ভাষায় খুব কষ্ট জর্জড়িত ভাষায় বলেন, মৃত্যু যন্ত্রনা কতটা ভয়াবহ তা প্রতিটা মুহুর্তে অনুভব করেছি। এখনো স্লিন্টারের আঘাতের ব্যাথা যন্ত্রনা দেয়। যা দিন দিন আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। হয়তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ যন্ত্রনা আমাকে বহন করতে হবে। সে রাতের ভয়াবহ ঘটনাটি আজও শিউরে উঠে শরীর ও মন। সেদিন রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। বিকট শব্দ। তারপরই অজ্ঞান। পরে জানতে পারি বোমা বিস্ফোরণের প্রায় ২০ মিনিট ওইখানেই পড়েছিলাম। আমার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এরপর আমার আত্মীয় রফিক আমাকে গাড়িতে করে তৎকালীন ২০০ শয্যা হাসপাতালে (বর্তমানে ৩০০ শয্যা খানপুর হাসপাতাল) পাঠায়। পরে আমার বড় ভাই মোতালিব হোসেন আমাকে নিয়ে ছুটাছুটি করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়। তখনও আমি অজ্ঞান। বর্তমান মহানগর আওয়ামীলীগ সহ সভাপতি রবিউল হোসেন বাসায় খবর পাঠায়। সেদিন ২০টির বেশি স্লিন্টারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। একেকটি স্লিন্টার যেন রাইফেলের একেকটি গুলির মতো। দুই দিন পর জ্ঞান ফিরে আসে। যখন জেগে উঠি তখন দেখি আমার ডান পার উপরের অংশ থেকে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। এরপর দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। শরীরে অসংখ্য স্লিন্টার নিয়ে এখনো বেঁচে আছি শুধু স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার দেখে যেতে চাই বলে।ঘটনার বিবরণে তিনি বলেন, ওইদিন আমরা ২৫ থেকে ৩০ জন লোক একটি ঘরে। ঘরটি চাষাঢ়া আওয়ামীলীগ অফিসের অংশ। পাশের বড় ঘরটিতে অনেক লোক আর সেখানে উপস্থিত ছিল সাংসদ জননেতা এ.কে.এম শামীম ওসমান তাই হৈ চৈ ও প্রচুর। সকল র্সব সাধারণদের সাথে জননেতা এ.কে.এম শামীম ওসমান তখন তাদের সুবিধা অসুবিধা ও সমাধান নিয়ে মতবিনিময় করছে। এতো হৈ চৈ এড়াতে আমরা দরজা বন্ধ করে পিছনের ছোট কক্ষটিতে দলীয় সভা করছি। হঠাৎ একটি শব্দ। আমি তখন দরজার বরাবরই বসা ছিলাম। চোখের সামনে মুহূর্তে নেমে এল অন্ধকার। ততক্ষনে কত কি ঘটেছে জানি না। কিন্তু আমি নিজেকে চেয়ার থেকে মাটিতে দেখতে পাই। এবং সবকিছুই লন্ডভন্ড, এলো মেলো ও অস্পষ্ট দেখতে পাই। অনেক মানুষকে ছুটাছুটি করতে দেখা যায়। হয়তো চিৎকার করছিলো কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না, আমি ও ডাকছিলাম কিন্তু কেউ যেন সাড়া দিচ্ছিল না।
খানপুর হাসপাতালে আমি আহত অবস্থায় পড়েছিলাম। আমার শরীরে আন্ডারওয়্যার ছাড়া কিছু ছিল না। ভীষণ শীত লাগছিল। অথচ আমার মনে আছে বাদ মাগরিব যখন চাষাঢ়া আওয়ামীলীগ অফিসে রৌওনা হই, তখন আমার পরনে চেক শার্ট, হলুদ রংয়ের ফুলপ্যান্ট এবং পায়ে জুতো। সাথে ছিল সেই সময় ছিল গ্রামীনের বিলিং পদ্ধিতির সংযোগ ও সিমেন্স মোবাইল ফোন, সিটিজেন ঘড়ি ও চোখে চশমা। আর পকেটে ছিল বাজার করার জন্য ৩ হাজার টাকা। এসব কিছুই পরর্বতীতে আর সন্ধান মিলেনি। শুধু আল্লাহর রহমতে আমি আছি।
আমার প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল। বুকে, পায়ে ও কোমরে স্লিন্টার ঢুকেছে। ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ চেপে ধরেও রক্ত স্রোত থামানো যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছিলাম, আমার জীবনের আয়ু শক্তি ফুরিয়ে আসছে। তাই চিকিৎসকরা আমাকে খানপুর হাসপাতালে না রেখে সবার আগে ঢাকায় প্রেরণ করেন। এটিএন, একুশেসহ অনেক ইলেকট্রনিক মিডিয়া চারদিকে প্রচুর ভীড় করে ভিডিও করছে। তার মধ্যে ক্যামেরা নিয়ে হাজির বিভিন্ন পত্রিকার ফটো সাংবাদিকরাও। হয়তো তখন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আমার প্রবেশটাই ছিল সবার আগে। অন্যদিকে আমার অবস্থা ক্রমান্নয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে আমার ভাই সাংবাদিকদের অনুরোধ করে তারা যেন যাওয়ার পথটা খালি করে দেয়। ততক্ষনে আমার শরীর প্রায় নিস্তেজ হয়ে এসেছে। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে অনিয়মিত। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে রক্ত দেয়া হল। অপারেশন করে বের করল কিছু স্লিন্টার। কিন্তু স্লিন্টারের আরও কিছু টুকরো বের করা সম্ভব হল না। সেগুলো রয়ে গেলো আমার দেহেই। পরদিন দুপুর ১ টায় পুলিশ আমার কাছে এল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল বোমা হামলা সম্পর্কে আমি কি জানি। বোমা হামলা কারা করেছে ? কিভাবে করেছে ইত্যাদি নানা প্রশ্নের মুখে আমি কোন তথ্য দিতে পারলাম না। বোমা হামলা আহত হওয়া ছাড়া এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। এমনকি তখন এও জানতাম না। কারা কারা নিহত বা আহত হয়েছে। এরই মধ্যে একদিন চলে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমাদের খোজঁ খবর নেন। আমার বেডটির সামনেও আসে আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্তনা দেয় তখন ওনার চোখেও ভেসে উঠে টলমল করছে অশ্রু। তারপর আমাদের দ্রুত সুস্থতায়, ভালো চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিকিৎসকদের নির্দেশ দেন ।পরিশেষে তিনি বলেন, তারপরেও আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি। কোন চাওয়া পাওয়া নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করেছি। উনার আদর্শ ধারণ করে তার কন্যার নির্দেশে আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি করেছি। তবে আজও অবাক হয়ে ভাবি কীভাবে বেঁচে আছি। আমার সাথের অনেক সহকর্মী নেই, কারো পা হারিয়েছেন। তাদের স্মরণ হলে আজও আমার চোখ ভিজে ওঠে। খোদা তাদেরকে বেহেশত নসিব করুক।