নারায়ণগঞ্জ নগরীর সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ তারা

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ : রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানকে কদাচিৎ একমঞ্চে দেখা যায়। তবে শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের এক গোলটেবিল বৈঠকে তাদের তিনজনকে একত্রে পাওয়া গেছে। তারা তিনজনই শহরের প্রধান দুই সমস্যা ‘যানজট ও হকার’ সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। বৈঠকে উপস্থিত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ও জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আমীর খসরুও এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

দুপুর বারোটায় শুরু হওয়া এই বৈঠক চলে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। এতে সভাপতিত্ব করেন নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি আরিফ আলম দীপু এবং সঞ্চালনা করেন ক্লাবের কার্যকরী সদস্য আফজাল হোসেন পন্টি। এই সময় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চন্দন শীল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) রুহুল আমিন সাগর, বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. শামসুল কবীর, নাসিকের কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের শুরুতে শহরের যানজট ও ফুটপাতের হকার সমস্যা নিয়ে নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। পরে এ নিয়ে আলোচনা করেন উপস্থিত জনপ্রতিনিধি ও সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা।

নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘৪০০ বছরের পুরোনো আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহর। কোলকাতা শহরের আগে বন্দর নগরী দিয়ে এ শহরের গোড়াপত্তন হয়েছে। ব্রিটিশরা এখানে এসেছে পাটসহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল। তখন এটা ছিল পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ। আমরা সেই পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ চাই। শামীম ভাই অনেকদিন পরে হলেও একমত হয়েছেন যে, ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে, যানজট নিরসন করতে হবে। এটা থেকে পজেটিভ দিক আর হতে পারে না।’

সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সড়কের অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো বন্ধ এবং রুট পারমিট ছাড়া যেন সড়কে কোন বাস চলতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রাকের নগরী হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে আমরা চাই না। আপনারা সরকারি কর্মকর্তা, আপনারা দলাদলি দেখবেন না, আপনাদের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবেন।’

শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্যে করে মেয়র বলেন, ‘ভাই আপনি যদি ঘোষণা দেন তাহলেই হবে। পুলিশকে আপনি বাধ্য করবেন। আপনি সংসদ সদস্য। আপনাদের কথায় পুলিশ, প্রশাসন চলে, মেয়রের কথা তারা শোনে না। এসপি-ডিসি আমারে পাত্তাই দেয় না। তাদের অনুরোধ করে আমার নিতে হয়।’

২০১৮ সালে হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মেয়র আইভীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। তবে হকারমুক্ত ফুটপাতের বিষয়টি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

এই প্রসঙ্গে আইভী বলেন, ‘৬০০ হকারকে পুনর্বাসন সিটি করপোরেশন করেছে। তারা দোকানগুলো বিক্রি করে দিয়ে আবারও ফুটপাতে চলে এসেছে। সড়ক ও ফুটপাতের মালিক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। অন্যরা খবরদারি করে হকার বসিয়ে টাকা তোলে, এখানে প্রশাসনেরও কিছু লোক রয়েছে। ২০১৮ সালে এ হকার ইস্যুতে যে ভুল বোঝাবুঝি আমার আর শামীম ভাইয়ের মধ্যে হয়েছে তাতে অনেকেই সুবিধা নিয়েছেন। সে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক। আজ আমরা একমত হয়েছি। এই শহর সুন্দর নগরী হোক।’

সিটি মেয়রের এই বক্তব্যের সাথে একাত্মতা পোষণ করে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানও বলেন, তারাও শহরের সড়কগুলো যানজটমুক্ত ও ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত চান। তারা জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারকে এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে তাগিদ দেন।

শামীম ওসমান বলেন, ‘আমরা ভালো কাজগুলো একসাথে করবো। শুধু একটি সড়ক হকারমুক্ত করলে হবে না, করলে সবগুলো সড়কই হকারমুক্ত করতে হবে। কোন যানবাহন রুট পারমিট ছাড়া চলতে পারবে না। এইটার ব্যবস্থা বিআরটিএ নেবে। আমার পক্ষ থেকে কোন প্রকার বাধা থাকবে না, সকলের ক্ষেত্রেও যেন তাই হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিআরটিএ প্রয়োজনের অতিরিক্ত গাড়ির পারমিশন দেবে না। আর সেক্ষেত্রে আমাদের নারায়ণগঞ্জের পরিবহন ব্যবসায়ীদের আগে মূল্যায়ন করা উচিত। অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে নির্দিষ্ট স্থানে স্ট্যান্ড দিতে হবে। আর অবৈধ স্ট্যান্ডে কেউ না কেউ টাকা তোলে। সেই ব্যাপারেও খোঁজ নিতে হবে। আর যানজট কমাতে ট্রেন লাইন চাষাঢ়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

আদমজীতে ইপিজেডের কারখানাগুলো ছুটি হলে সেখানে প্রতিদিন যানজট দেখা দেয় উল্লেখ করে এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এই স্থানে একটা ফুটওভার ব্রিজ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আমি আর আইভী একটা কাগজে সই করে পাঠালেও এটা সমাধান হয়ে যাবে।’

সেলিম ওসমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে সমস্যার শেষ নেই। আজকে আমরা উঠে গেলাম আর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা নয়। রাস্তার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের হাতে। ফুটপাত কার হাতে? এটা কি মাসলম্যানদের হাতে? এই দখলকারীরা কারা? এদের চিহ্নিত করতে হবে। আমরা একত্রিত থাকলে একটা ফুটপাতও দখলে থাকবে না।’

‘এখানে কোন রাজনীতি থাকবে না। রাজনীতি একটাই, নারায়ণগঞ্জের মানুষকে শান্তিতে চলাচল করতে দিতে হবে। আমরা মেয়রকে অবশ্যই সহযোগিতা করব। আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জে কোনো সমস্যা রাখব না। আমার মেয়র আইভীকে নিয়ে আমার ছোটভাই শামীম ওসমানকে নিয়ে আমরা এটা করব’, যোগ করেন তিনি।

মেয়র ও দুই সংসদ সদস্যের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, শহরকে যানজটমুক্ত করার ব্যাপারে আগামীকাল (রোববার) থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে।

‘প্রত্যেকে পজেটিভ নারায়ণগঞ্জ চাচ্ছেন। আপনাদের কথায় আমি সাহস পাচ্ছি। আমি এরকম একটি ঐক্যমত চাচ্ছিলাম। নারায়ণগঞ্জে রুট পারমিট ছাড়া কোন গাড়ি চলবে না। সড়কের পরিমাপ অনুযায়ী সড়কে যানবাহন চলবে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। গত ৫ মাসে সাড়ে ৪৫০ যানবাহনে জরিমানা করা হয়েছে। আগামীকাল থেকে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট সড়কে থাকবে। অবৈধ স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো। কোন অবৈধ স্ট্যান্ড থাকবে না।

এই বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে জেলা পুলিশ সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) আমীর খসরু। তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধিরা ঐক্যমন্ত্রীর ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত দিবে আমরা সেটি দ্রুত বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ সহায়তা করবো।

নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি আরিফ আলম দীপু বলেন, আমরা যদি একসাথে কাজ করি তাহলে কোন সমস্যা থাকবে না। নারায়ণগঞ্জের অনেক সমস্যা আছে। আমরা আজকে শুধু যানজট ও ফুটপাত নিয়ে কথা বলবো। পর্যায়ক্রমে নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য সমস্যা নিয়ে কাজ করবো। অতীত ভুলে নতুন যুগের সূচনা হবে। আজ কেউ কারো বিরুদ্ধে কথা বলবো না। আমরা শুধু সমস্যার কথা বলবো। সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে কাজ করবো।

সূচনা বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জীবন বলেন, নারায়ণগঞ্জ জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখে আসছে। কিন্তু দেশের ধনী জেলা হলেও প্রত্যাশিত সেবা বঞ্চিত। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সমস্যা চিহ্নিত করা জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের দায়িত্ব সমাধান করা। অতীতের সব বিভেদ ভুলে আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর নগরী গড়ে তুলতে আপনারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করবেন। আজকে থেকে নারায়ণগঞ্জে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।

add-content

আরও খবর

পঠিত