নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( স্টাফ রিপোর্টার ) : বোমা হামলায় গুরুতর আহত হন তৎকালীণ চাষাড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সহ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান। প্রতিবছরই ১৬ই জুন নৃশংস বোমা হামলায় হতাহতদের স্মরণে মোমবাতী প্রজ্জ্বোলন ও ফুলের শ্রদ্ধা অর্পণ করতে উপস্থিত হন শহীদ মিনারের পাশে স্মৃতি স্তম্ভে। তবে ছোট স্ট্রোক হওয়ার কারণে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট থাকায় বর্তমানে শয্যা রয়েছেন তিনি। তাই এবার আর হয়নি সেখানে যাওয়া, আর এতে করে নেননিও কেউ কোন খোঁজ খবর। সোমবার সকালে প্রতিবেদকের সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন।
দিনটি পালনে এবার তিনি কেন উপস্থিত হননি? দলীয় নেতাকর্মীরা খোঁজ খবর রাখেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছি। উনার আদর্শেই রাজনীতিতে পর্দাপন। দলকে ভালবাসি, তাই এর স্বার্থে র্সবদাই বিভিন্ন কর্মসূচী পালনে আমি সোচ্চার ছিলাম। এখনকার রাজনীতিতে যে কলা কৌশল তা থেকে বলা চলে অনেকটাই আমি অনাবিজ্ঞ। যতটুকু আছি মানুষের সম্মান আর ভালবাসায় আছি। বয়স হয়ে গিয়েছে, রাজনীতি করে কিছু পাওয়ার আর আশা নেই। সকলের যে সম্মান পাই তা নিয়ে আল্লাহকে ডেকে স্বাভাবিক মৃত্যু এখন কামনা। শুধু সন্তানাদির উজ্জল ভবিষ্যত কামনা করি। আমি তো নৃশংস বোমা হামলায় সেদিনই মরে গিয়েও বেচেঁ গেছি। প্রথম বছরখানেক অন্তত এ দিনটি এলে ফোন পেতাম অংশগ্রহন করার জন্য, সেসময় খোঁজ খবর নিলেও এখন আর কেউ নেন না। তারপরেও শুকরিয়া বেঁচে আছি। মৃত্যু হলে কে খোঁজ নিতো?
সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্তমান ১৩নং ওয়ার্ড ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান জানান, মৃত্যু যন্ত্রনা কতটা ভয়াবহ তা প্রতিটামুহুর্তে অনুভব করেছি। এখনো স্প্লিন্টারের আঘাতের ব্যথা যন্ত্রনা দেয়। যা দিন দিন আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। হয়তো মৃত্যুর আগ র্পযন্ত এ যন্ত্রনা আমাকে বহন করতে হবে। সে রাতের ভয়াবহ ঘটনাটি আজও শিউরে উঠে শরীর ও মন। সেদিন রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। বিকট শব্দ। তারপরই অজ্ঞান। পরে জানতে পারি বোমা বিস্ফোরণের প্রায় ২০ মিনিট ওইখানেই পড়েছিলাম। আমার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এরপর আমার আত্মীয় রফিক আমাকে গাড়িতে করে তৎকালীন ২০০ শয্যা হাসপাতালে পাঠায়। পরে আমার বড় ভাই মোতালিব হোসেন আমাকে নিয়ে ছুটাছুটি করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়। তখনও আমি অজ্ঞান। বর্তমান মহানগর আওয়ামীলীগ সহসভাপতি রবিউল হোসেন বাসায় খবর পাঠায়। সেদিন ২০টির বেশি স্প্লিটারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। একেকটি স্প্লিন্টার যেন রাইফেলের একেকটি গুলির মতো। দুইদিন পর জ্ঞান ফিরে আসে। যখন জেগে উঠি তখন দেখি আমার ডান পার উপরের অংশ থেকে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। এরপর দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে এখনো বেঁচে আছি শুধু স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার দেখে যেতে চাই বলে।
ঘটনার বিবরণে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ওইদিন আমরা ২৫ থেকে ৩০ জন লোক একটি ঘরে। ঘরটি চাষাঢ়া আওয়ামীলীগ অফিসের অংশ। পাশের বড় ঘরটিতে অনেক লোক আর সেখানে উপস্থিত ছিল সাংসদ জননেতা এ.কে.এম শামিম ওসমান তাই হৈ চৈ ও প্রচুর। সকল র্সব সাধারণদের সাথে জননেতা এ.কে.এম শামিম ওসমান তখন তাদের সুবিধা অসুবিধা ও সমাধান নিয়ে মতবিনিময় করছে। এতো হৈ চৈ এড়াতে আমরা দরজা বন্ধ করে পিছনের ছোট কক্ষটিতে দলীয় সভা করছি। হঠাৎ একটি শব্দ। আমি তখন দরজার বরাবরই বসা ছিলাম। চোখের সামনে মুহূর্তে নেমে এল অন্ধকার। ততক্ষনে কত কি ঘটেছে জানিনা। কিন্তু আমি নিজেকে চেয়ার থেকে মাটিতে দেখতে পাই। এবং সবকিছুই লন্ডভন্ড, এলোমেলো ও অস্পষ্ট দেখতে পাই। অনেক মানুষকে ছুটাছুটি করতে দেখা যায়। হয়তো চিৎকার করছিলো কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না, আমি ও ডাকছিলাম কিন্তু কেউ যেন সাড়া দিচ্ছিলনা।
খানপুর হাসপাতালে আমি আহত অবস্থায় পড়েছিলাম। আমার শরীরে আন্ডারওয়্যার ছাড়া কিছু ছিল না। ভীষণ শীত লাগছিল। অথচ আমার মনে আছে বাদ মাগরিব যখন চাষাঢ়া আওয়ামীলীগ অফিসে রওয়ানা হই, তখন আমার পরনে চেক শার্ট, হলুদ রংয়ের ফুলপ্যান্ট এবং পায়ে জুতো। সাথে ছিল গ্রামিনের বিলিং পদ্ধিতির সংযোগ ও সিমেন্স মোবাইল ফোন, সিটিজেন ঘড়ি ও চোখে চশমা। আর পকেটে ছিল বাজার করার জন্য ৩ হাজার টাকা। এসব কিছুই পরর্বতিতে আর সন্ধান মিলেনি। শুধু আল্লাহর রহমতে আমি আছি।
আমার প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল। বুকে, পায়ে ও কোমরে স্প্লিন্টার ঢুকেছে। ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ চেপে ধরেও রক্ত স্রোত থামানো যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছিলাম, আমার জীবনের আয়ু শক্তি ফুরিয়ে আসছে। তাই চিকিৎসকরা আমাকে খানপুর হাসপাতালে না রেখে সবার আগে ঢাকায় প্রেরণ করেন। এটিএন , একুশেসহ অনেক ইলেকট্রনিক মিডিয়া চারদিকে প্রচুর ভীড় করে ভিডিও করছে। তার মধ্যে ক্যামেরা নিয়ে হাজির বিভিন্ন পত্রিকার ফটো সাংবাদিকরাও। হয়তো তখন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আমার প্রবেশটাই ছিল সবার আগে। অন্যদিকে আমার অবস্থা ক্রমান্নয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে আমার ভাই সাংবাদিকদের অনুরোধ করে তারা যেন যাওয়ার পথটা খালি করে দেয়। ততক্ষনে আমার শরীর প্রায় নিস্তেজ হয়ে এসেছে। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে অনিয়মিত। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে রক্ত দেয়া হল। অপারেশন করে বের করল কিছু স্প্লিন্টার। কিন্তু স্প্লিন্টারের আরও কিছু টুকরো বের করা সম্ভব হল না। সেগুলো রয়ে গেলো আমার দেহেই। পরদিন দুপুর ১ টায় পুলিশ আমার কাছে এল। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল বোমা হামলা সম্পর্কে আমি কি জানি। বোমা হামলা কারা করেছে? কিভাবে করেছে ইত্যাদি নানা প্রশ্নের মুখে আমি কোন তথ্য দিতে পারলাম না। বোমা হামলা আহত হওয়া ছাড়া এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। এমনকি তখন এও জানতাম না। কারা কারা নিহত বা আহত হয়েছে। এরই মধ্যে একদিন চলে আসে দেশ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং আমাদের খোজঁ খবর নেন। আমার বেডটির সামনেও আসে আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্তনা দেয় তখন ওনার চোখেও ভেসে উঠে টলমল করছে অশ্রু। তারপর আমাদের দ্রুত সুস্থতায়, ভালো চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন চিকিৎসকদের।
পরিশেষে তিনি বলেন, তারপরেও আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি। তবে আজও অবাক হয়ে ভাবি কীভাবে বেঁচে আছি। আমার সাথের অনেক সহকর্মী নেই, কারো পা হারিয়েছেন। তাদের স্মরণ হলে আজও আমার চোখ ভিজে ওঠে। খোদা তাদেরকে বেহেশত নসিব করুক।