নারায়ণগঞ্জের গর্ব বাদ্যজাদুকর মো: লুৎফর রহমান

নারায়ণগঞ্জ বার্তা ২৪ ( সৈয়দ সিফাত আল রহমান লিংকন ) : মাত্র একটি শব্দ বাঁশি। কিন্তু এরই মাঝে লুকায়িত হাজারো সুখ, দু:খ, বেদনা ও আনন্দ। দুই অক্ষরের এই ফুৎকার বাদ্যযন্ত্রটি একই সঙ্গে প্রেম ও প্রলয় এবং জীবন ও মৃৃত্যুর প্রতীক। এই বাঁশির সুর, কার-ই বা না ভালো লাগে। যখনই বেঁজে উঠে বিমোহিত মন কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তাইতো মুনিম সিদ্দিকী কবিতার ভাষায় লিখেছেন, বাঁশি চাই, বাঁশির গান চাই-বাঁশির সুর চাই! অমরত্বের গুপ্তধন চাই-সে সুরে। অস্তিত্ব বিনাশের পরও যে বাঁশি বিলাপ করে !

যমুনার তীরে যেমন একজন মুরলি বাঁশিওয়ালা বসবাস করেন, যার বাঁশির শব্দে নর-নারীর হৃদয়ে প্রেম-বিরহের ঝড় উঠে, তেমনি অন্য একজন বাঁশিওয়ালা আছেন, যার বাঁশি বেজে উঠলে প্রলয় আতঙ্কে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরও বাঁশি। বাঁশি বড় প্রিয়, বড় আদরের ধন। বাঁশি নিয়েই যার জীবন মরণ আর সর্বস্থল। সে আর কেউ নন নারায়ণগঞ্জের গর্ব বংশীবাদক মো: লুৎফর রহমান। যুগে যুগে বাঁশির সাথেই যার বসবাস।

প্রাণ সখিরে ওই কদমব তলে বংশি বাজায় কে/ বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি/ ওরেও বাঁশি ওয়ালা আমারি মনের জ্বালা সইতে আর পারিনা..বাঁশি নিয়ে এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গান আজও মানুষের মুখে মুখে। হিন্দি ও ওয়েস্টাান মিউজিকের এই যুগেও বাঁশি এখনো দেশী বাদ্য যন্ত্র হিসাবে এই দেশের সাংস্কৃতিক জগতে বিশেষ একটা স্থান করে আছে। গ্রামের রাখাল এখন আর হয়ত আগের মত মাঠে বসে পাগল করা সুরে বাঁশি বাজায়না কিন্তু এখনো প্রাণ কাড়া বাশির সুরে মানুষ যে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয় তার জীবন্ত মডেল এই বংশীবাদক মো: লুৎফর রহমান । বর্তমানে তিনি সেই বাঁশির সুরে বিমোহিত করতে নিয়োজিত আছেন রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে। র্দীঘ দুই যুগ ধরেই তিনি সোনারগাঁও হোটেলে অতিথিদের মন মুগ্ধ করতে এক অনন্য বাদ্য জাদুকরের ভূমিকা পালন করছে।

বংশীবাদক মো: লুৎফর রহমান ১৯৬৪ সালের ১লা জানুৃয়ারী নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম ডা: টি হোসেন এবং মাতার নাম তাম্বিয়া বেগম। সুর সম্রাট তানরাজ খানের বংশধর ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খানের ছেলে ইয়াসীন খানের কাছে প্রথম হাতে খড়ি। তারপর খুরশীদ আনোয়ারের কাছ থেকে তালিম নেওয়া। ১৯৮২ সালে জীবীকার তাগিদে কাতার আসেন। ১৯৮৭ মালে তিনি তোলারাম কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন এবং বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রের একজন গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিত হন। ১৯৭৭ সালে রেডিওতে প্রথম গাওয়ার সুযোগ পান। অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকলেও প্রতিসাসে রেডিওতে দুইবার রাগ লহরী প্রোগ্রাম করে থাকেন। এতকিছুর পরও বাশিঁ বাদক হিসেবেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা র্অজন করেছেন। র্বতমানে তিনি প্যানপ্যসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বাঁশিবাদক হিসেবে কর্মরত আছেন। মো: লুৎফর রহমান হোটেলটির একজন বেতনভুক্ত বংশীবাদক। তাঁর জন্য তৈরী করা আছে এক রাজকীয় শৈল্পীক আসন। সিড়ির কাছে ব্যালকনিতে বসেই তিনি এই মনমুগ্ধকর বাদ্যযন্ত্রটি বাজান। যখোনে রয়েছে খয়েরী রংয়ের রাজকীয় কারুকাজ করা একটি ছোট পালঙ্ক। পালঙ্কের ঝলমলে মখমলের কাপড়ে ঢাকা, পাশে বালিশ। পেছনের দেয়ালটিও কারুকাজ করা। শুক্র-শনিবার প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বাঁশি বাজান তিনি। লবিতে নকশা করা কাঠের তৈরী আসর পাতা আছে। তার উপর রাজকীয় বালিশ-কুশন। সেখানেই বসে ওস্তাদি পোশাক পড়ে বাঁশিতে তুলেন বাহারী সুর। হারানো দিনের গান, পল্লীগীতি, আরবী, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজী ও পঞ্জাবি গানের সুরে বাঁশি বাজান নিয়মিত। বিভিন্ন সময়ই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ডাক আসে তাঁর বাঁশি বাজানোর জন্য। তখন তাদের জন্যও বাজান। এই বংশীবাদকের বয়স প্রায় ৬৫ বছর।

১০ই আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতে মো: লুৎফর রহমানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি হাসিমুখেই জানালেন তাঁর বংশীবাদক হওয়ার গল্প। তিনি বলেন, হোটেল কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় বংশীবাদক চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। তা দেখে অন্যদের সঙ্গে আমিও ইন্টারভিউ দিই। আমিই প্রথম হই। তারপর থেকে বাজিয়েই যাচ্ছি। এক র্পযায় তিনি বললেন, আমি তো আর টেপরেকর্ডার না। তাই বাজানোর মাঝে মাঝে একটু বিরতি তো নিতেই হয়। লুৎফর রহমান এখানে কাজ শুরুর আগে কাতার এবং ভারতেও বাঁশি বাজানোর কাজ করেছেন। ইংরেজি ভাষাটার পাশাপাশি হিন্দি, উর্দু এবং আরবিও জানেন তিনি। বিদেশি অতিথিরা বিভিন্ন ভাষার গানের সুরে বাঁশি বাজাতে অনুরোধ করলে তা খুশিমনেই বাজিয়ে শোনিয়েছেন। স্ত্রী জ্যোৎস্না রহমান তাঁর এই বাঁশি বাজানোর কাজে উৎসাহ দেন বলেই জানালেন লুৎফর রহমান। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেও মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে গিটার বাজান। বড় ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনি নিয়ে লুৎফর রহমানের সংসার। প্রতিদিন সকাল এবং দুপুরে হোটেলের খাবার খান লুৎফর রহমান। একদিন হোটেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে এসেছিলেন। লুৎফর রহমান প্রতিদিন এ ধরনের খাবার খান দেখে পরিবারের সবাই খুব অবাকও হয়েছিলেন।

আর কত দিন বাঁশি বাজাবেন জানতে চাইলে লুৎফর রহমান বলেন, শরীর-স্বাস্থ্য যত দিন ভালো থাকবে, তত দিনই বাজাব। হোটেলের অতিথিরা ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখে, বাজনা পছন্দ করে, তখন অনেক ভালো লাগে।

তিনি তাঁর অনুভুতি নিয়ে বলেন, এখানে এসেই দেশী-বিদেশী অনেক লোক তার বাঁশির সুর শোনেছে। এখানে তাঁর বাঁশি শুনে ওস্তাদ হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া শুভ কামনা করেছেন। ভারতের জনপ্রিয় নায়িকা হেমা মালিনী তাঁর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে কাছে এসে কথা বলেছেন। বংশীবাদক লুৎফর রহমান বাসায় বসেই অনেককে তালিমও দেন। আর বিভিন্ন জায়গায় তারা এখন ভালো বাজাচ্ছেও। এছাড়াও নিজের একটি দলও গঠন করেছেন যার নাম ( চেইন জারস )। এই জাদুকরী সুরের বিমোহীত হতে বিভিন্ন পাচঁ তারকা হোটেলে তাকে নিমন্ত্রনও করা হয়। তিনি ক্লাসিক বাজান বেশ সময় ধরে। বেলা ১১ টার পরে সময় দেন পরিবারের সাথে। আর ছুটির দিনে প্রথমেই ছুটে যায় বোস কেবিনে। প্রিয় বন্ধু ও শোভাকাঙ্খীদের সাথে আড্ডা দিয়েই তার দিন কাটিয়ে থাকেন। পরিশেষে হাসিমুখেই তারঁ কাছে বিদায় নেয়াটাও ছিলো শেষ নয়, এই যেনো শুরু মাত্র। মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমিও তার ব্যবহারে। একজন শিল্পী কতটা সদালাপী ও মহৎ হতে পারে তা বিধাতারই দান। সুরের মুর্ছনায় এ শিল্পী শুধু বাদ্যযন্ত্রই রপ্ত করেনি, শৈল্পীক কলাকৌশলে কেড়ে নিচ্ছে লক্ষাধিক ভক্তের ভালোবাসা ও রপ্ত করে নিয়েছে তাদের মন।

add-content

আরও খবর

পঠিত